Close

স্পেশাল বাচ্চাদের (অটিজম) শিক্ষা, বাস্তব চিত্র, চ্যালেঞ্জ ও সমাধানের পথ

সাজেদা সুলতানা কলি

স্পেশাল বাচ্চাদের পড়াশোনা এবং শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে তিন বছর আগে প্রথম আলোর অনলাইনে আমার একটা লেখা প্রকাশিত হয়েছিলো। ২০১৬ সালে সরকারি উদ্যোগে আয়োজিত একটি কর্মশালায় অবিভাবক প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলাম। সেখানে বলা হয়েছিলো স্পেশাল বাচ্চাদের পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের ধরণে পরিবর্তন আনয়ন এবং উত্তরপত্রের শীথিল মূল্যায়নের কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ফলাফল আসেনি। আধঘন্টা বাড়তি সময়ের সুবিধা ছাড়া সুস্থ স্বাভাবিক বাচ্চারা যে প্রশ্ন দিয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে স্পেশালরাও সেটা দিয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে। বেশিরভাগ স্পেশাল বাচ্চাদের বিশেষ করে ( অভিজ্ঞতা থেকে বলছি) অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার যাদের তাদের লেখার প্রতি খুব অনীহা থাকে। এরা মুখে মুখে ছড়া, কবিতা, গান সব কিছু বলে, পড়ে।কিন্তু লিখতে চায় না। যাদেরকে দেখেছি তাদের এখনকার অবস্থা জানি না। তবে আমার ছেলের ক্ষেত্রে সেটা এখনো আছে। বিশেষ করে পরীক্ষার সময় এ বিষয়টা খুব চাপ সৃষ্টি করে। সম্পূর্ণ প্রশ্নের উত্তর লিখে শেষ করতে পারেনা বলে সে অপরাধবোধে ভোগে। যার জন্য পরবর্তী পরীক্ষার প্রতি তার মধ্যে একধরণের ভীতির সৃষ্টি হয়। এবং আমরাও মানসিক চাপের মধ্যে থাকি। ওদের যেহেতু একসাথে একাধিক নির্দেশনা মনে রাখা এবং মেনে চলা কষ্টকর সেহেতু তাদের ভাবনা এবং লেখা দুটো সমান গতিতে চলতে পারেনা। তাছাড়া অনেক বাচ্চাকে দীর্ঘ সময় একনাগাড়ে বসিয়েও রাখা যায় না। তাই লেখায় পিছিয়ে পড়ে। বড় প্রশ্নগুলোর উত্তর লিখতে গিয়ে বাচ্চা যখন হাইপার হয়ে উঠে তখন নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়। পরের দিনের পরীক্ষার জন্য আবার তাকে ম্যানেজ করতে হয়। আধঘন্টা বাড়তি সময় দেওয়ার চেয়ে প্রশ্নপত্রের ধরন পরিবর্তন করে পুরো প্রশ্ন নৈর্ব্যক্তিক অথবা একলাইনের উত্তর হলে তাদের শিক্ষা তথা পরীক্ষার ক্ষেত্রটা একটু সহজ হতো। এই ব্যবস্থায় উত্তরপত্রের শিথিল মূল্যায়নেরও তেমন প্রয়োজন হবে বলে মনে হয় না। কারণ ASD (Autism Spectrum Disorder) বাচ্চাদের মোটামুটি যে মেধা আছে তাতে তারা এটুকু প্রশ্নের উত্তর সহজে করতে পারবে। প্রথম পরীক্ষাটা দেওয়ার পর বাকি পরীক্ষার জন্য বাচ্চা চাপ মুক্ত থাকবে। এবং পড়াশোনা বা পরীক্ষার প্রতি তার ভীতিও দূর হবে। তবে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড পরীক্ষার সময় অটিজম আক্রান্ত বাচ্চাদের সাথে তাদের বাবা / মাকে পাশে বসে থাকার অনুমতি দিয়ে একটা অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এ বাচ্চাগুলো শারীরিকভাবে সক্ষম হলেও মানসিকভাবে খুব অসহায় বোধ করে। এবং সেটা যথাযথভাবে প্রকাশ করতে পারেনা বলে অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করে বসে। আবার সময় জ্ঞান নেই বলে নির্দিষ্ট সময়ে লিখে শেষ করার বিষয়টারও গুরুত্ব অনুভব করতে পারেনা। আমার ছেলের ক্ষেত্রে দেখলাম লেখার প্রতি তার অনীহা থাকলেও আদর করে, প্রশংসা করে এবং ভরসা দিয়ে বোঝালে বেশ ভালো লিখে। কিন্তু কেউ প্রশ্নের উত্তর বলে দিলে অথবা লেখার নিয়ম দেখিয়ে দিলে সেটা পছন্দ করেনা, বরং উত্তেজিত হয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে পরিবেশ অশান্ত করে তোলে। তার হাইস্কুলের এক ম্যাডাম ইংরেজি একটা প্রশ্নের উত্তর শুদ্ধ করে লিখে দিয়েছিলেন বলে পুরো লেখা কেটে সে আবার লিখেছে। এতে সময়ও নষ্ট হলো লেখাও শেষ করতে পারেনি। কারো খাতাও দেখবেনা। মন চাইলে নিজের মতো করে লিখবে আবার মন না চাইলে লিখবেনা। এসএসসি পরীক্ষার সময় সে ত্রিশ পঁয়ত্রিশ নম্বরের উত্তর লিখে বলে আর লিখবেনা। অটিজম আক্রান্ত প্রতিটা বাচ্চার আলাদা বৈশিষ্ট্য। আমার ছেলের সাথে অন্য যারা ছিলো তাদের রাইটার লেগেছে। এদিক থেকে আমি খুব লাকি ছিলাম। ছেলে নিজের হাতে লিখেছে। আমার কাজ ছিলো একটু পর পর আদর করে গায়ে হাত বুলিয়ে তাকে লিখতে উৎসাহ দেওয়া। আদর ভালোবাসার কাঙ্গাল এই বাচ্চাগুলোকে কেউ একটু স্নেহের সুরে কথা বললে তার খুব ভক্ত হয়ে যায়। যাইহোক, কলেজে ভর্তির পর সব পরীক্ষা একা একাই দিয়েছে। কিন্তু নির্বাচনী পরীক্ষার আগে আমাকে বললো আমি যেন তার পাশে বসি। কলেজ কর্তৃপক্ষ নির্দ্বিধায় আমাকে অনুমতি দিলেন। আসলে কলেজের স্যার ম্যাডামদের সহযোগিতা না থাকলে হয়তো ছেলেকে কলেজে পড়াতে পারতাম না। এজন্য আমি তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ।

ব্যয় ও মানের ভারসাম্যে সংকটে স্পেশাল এডুকেশন-

এবার আসি স্পেশাল স্কুল প্রসঙ্গে। স্পেশাল স্কুল, স্পেশাল এডুকেটর এবং স্পেশাল বাচ্চার (অটিজম) প্যারেন্টসদের মধ্যে যে স্নায়ু যুদ্ধ চলছে এটা কারও জন্যই কল্যাণকর নয়। সামান্য অভিজ্ঞতা বা জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে একটা ইনস্টিউশন প্রতিষ্ঠা করা এবং সেটা চালিয়ে নেওয়া সহজ কাজ নয়। সত্যি বলতে অসাধু লোকজন সব সেক্টরেই আছে এবং থাকে। এরা মানুষের দুর্বল জায়গা চিহ্নিত করে নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করে নেয়। একাডেমিক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ ছাড়া স্পেশাল স্কুল খুলে বসলে সে স্কুলের কোয়ালিটি নিয়ে বিতর্ক হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি মনে করি স্কুলগুলোতে ট্রেইনার হিসেবে প্যারেন্টসদের অংশ গ্রহণের সুযোগ থাকলে এই লড়াই থামবে। প্রতিটা স্পেশাল স্কুলে যোগ্যতা অনুযায়ী তিন চার জন করে প্যারেন্টস দায়িত্বে থাকলে তারা বাচ্চাদের যেমন ভালো দেখাশোনা করতে পারবেন তেমনি বাবা মায়েদের কষ্টটাও অনুভব করতে পারবেন। এতে দুই পক্ষের মধ্যে একটা সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হবে এবং বাচ্চার ডেভেলপমেন্টও এগিয়ে যাবে।

একটা সময় ছিলো স্পেশাল স্কুলগুলো এতটা ব্যয়বহুল ছিলোনা। গার্জিয়ানদের সাথেও টিচারদের সহযোগিতার সম্পর্ক ছিলো। আমার বাচ্চা একনাগাড়ে সাত বছর একই স্কুলে ছিলো। তার এই পর্যন্ত আসার পেছনে স্কুলের টিচারদের অবদান কখনও অস্বীকার করতে পারবোনা। এখনও আমি কোনো সমস্যায় পড়লে তাঁদের কাছে যাই। মাধ্যমিক স্কুলের টিচাররাও সব সময় সহযোগিতা করে গেছেন। কখনও কোনো অভিযোগ করেননি। এখন কলেজে পড়ছে। এখানেও সবাই ওকে যথেষ্ট সহযোগিতা করছেন। অন্য ডিপার্টমেন্টের স্যার ম্যাডামদেরও দেখলাম আমার ছেলের বিষয়ে খোঁজ খবর নিতে। কিন্তু এখন বেশিরভাগ স্পেশাল স্কুল এডমিশন ফি নিচ্ছে চল্লিশ থেকে ষাট হাজার টাকা আর মাসিক বেতন আট থেকে পঁচিশ হাজার টাকা। যেটা বহন করা উচ্চ মধ্য বিত্তের জন্যও অসম্ভব। সেখানে অসচ্ছল বাবা মা তার স্পেশাল বাচ্চাকে স্কুলে দেওয়ার কথা ভাবতেও পারেন না। অভিভাবকদের অভিযোগ হলো এতো মাত্রা ছাড়া খরচ কেন লাগবে? তাছাড়া এমনও না যে কিছুদিন স্পেশাল স্কুলে রাখলেই বা থেরাপি দিলেই হয়ে যাবে। এটা তো দিনের পর দিন চালিয়ে নিতে হবে।


অনেক অভিভাবক খরচের ভয়ে বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করতে সাহস পান না। নরমাল স্কুলে দিলেও সেখানে টিকতে পারেনা। তাছাড়া নরমাল স্কুলে যাওয়ার উপযোগী করতে হলে বাচ্চাকে অবশ্যই স্পেশাল স্কুল থেকে প্রস্তুত করতে হবে। সেটাও দীর্ঘ মেয়াদি প্রক্রিয়া। এমন অবস্থায় বাবা মাও মানসিক সমস্যায় ভোগেন। কর্তৃপক্ষ যদি এই বিষয়টাতে নজর না দেয় তাহলে এই সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করবে। কারণ বাচ্চাকে ভালো রাখতে হলে প্যারেন্টসের বিশেষ করে মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হবে। বাচ্চার অটিজম শনাক্ত হওয়ার সাথে সাথে স্পেশাল স্কুলে এডমিট করলে বাচ্চা এবং পরিবার দুটোর জন্যই ভালো।


অটিজম কিউরেবল না হলেও ম্যানেজেবল। আর এই ম্যানেজ করার জন্য স্পেশাল স্কুলে ভর্তি অবশ্যই প্রয়োজন। যেহেতু এটা একটা লাইফ টাইম কন্ডিশন সেহেতু মূল ভিতটা তৈরী না হলে যত বয়স বাড়বে তত বেশি পরিবারের বোঝা হয়ে উঠবে। আবার এসব বাচ্চার আচরণ সবসময় একরকম থাকে না যে একবার ম্যানেজ করলে ঠিক হয়ে যাবে।

যদিও বাচ্চার জন্য প্রধান স্কুল নিজের বাসা তারপর ইনস্টিটিউশন। এটা সব বাচ্চার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তবুও প্রফেশনালদের সাপোর্ট নিতে হয়। ব্যয়বহুল এসব স্কুলের শিক্ষক এবং অভিভাবকদের মধ্যে সাপে নেউলে সম্পর্কের জন্য স্পেশাল বাচ্চাগুলো যেমন অবহেলার শিকার হচ্ছে তেমনি তাদের বাবা মায়ের দাম্পত্য সম্পর্কও দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। এদিকে খরচ বাঁচাতে পাড়া মহল্লার স্কুল অথবা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাচ্চাকে দেওয়া মানে তার ডেভলেপমেন্ট পিছিয়ে দেওয়া। স্কুলের উচ্চ মূল্যের বেতন ফি ছাড়াও স্পেশাল বাচ্চাদের পেছনে ওষুধ পথ্যসহ প্রচুর খরচ। সেটা বহন করতেও বাবা মায়ের নাভিশ্বাস উঠে যাওয়ার যোগাড়। স্পেশাল বাচ্চার অভিভাবকদের ইমোশনকে পুঁজি করে স্কুলের সাথে পাল্লা দিয়ে যত্রতত্র গড়ে উঠছে উচ্চমূল্যের থেরাপি সেন্টারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। যার একমাত্র উদ্দেশ্য পকেট ভরা।

inclusive education in india pic15845991261584599126

সবশেষে এটাই বলবো স্পেশাল নীড বাচ্চার ভালো ডেভেলপমেন্টের জন্য প্যারেন্টসের প্রধান পুঁজি হলো ধৈর্য্য, ধৈর্য্য এবং ধৈর্য্য। আর সেটার সাপোর্টার হিসেবে প্রয়োজন স্পেশাল স্কুল এবং স্পেশাল স্কুলের টিচারদের সাথে অভিভাবকদের সুসম্পর্ক।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Leave a comment
scroll to top