জান্নাতুল তহুরা
আকাশ মধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র সন্তান। সবেমাত্র কলেজে পড়ে। আর নীলিমা হচ্ছে ধনী বাবার একমাত্র মেয়ে। নীলিমার মা গত হয়েছে সেই তার বাল্যকালে। তাই মায়ের স্নেহ,মমতা থেকে সে বঞ্চিত সেই ছোট থেকে! সে এবার কলেজের ভর্তি পরীক্ষাতে প্রথম হয়েছে। যেমন সুন্দরী, তেমনই তার মেধা। তাই কলেজের সব ছেলেদের সপ্নে দেখা রাজকন্যা সে এই কথা বলতে কোন দ্বিধা নেই! কলেজের প্রথম দিন থেকেই আকাশ নীলিমার কথা শুনছে, কিন্ত তাকে চোখে দেখেনি। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল যেদিন সেদিন ছিল তাদের প্রথম দেখা। সেদিন নীলিমা গান গাইছিল “ভালোবাসি যারে”। এই প্রথম দেখায় আকাশ সপ্নের রাজ্যে চলে গিয়েছিল। তার আগে কোনও মেয়েকে এত ভাল লাগেনি। তারপর তাদের পরিচয় হয়। আকাশ প্রতিদিনই নীলিমার সাথে দেখা করার বাহানা বানাতো। ধীরে ধীরে তাদের বন্ধুত্ব হয়। একসময় দেখা যায় আকাশ আর নীলিমা যে ভাল বন্ধু এই কথা কলেজের সবাই জানে! কিন্ত এদিকে আকাশের জমানো আবেগগুলো গাঢ় হতে থাকে, তার মন ব্যাকুল হয়ে যায়। পড়াশোনাতে তার আর মন নেই, পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হতে থাকে। আর নীলিমা বরাবর এর মত এবারও প্রথম হয়। নীলিমা আকাশকে পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়ার কারণ জানতে চায় কিন্ত সে কিছুই বলতে পারে না। দেখতে দেখতেই এক বছর চলে যায়, তারা দ্বিতীয় বর্ষ উঠে যায়। তবুও আকাশ কিছুই বলতে পারে না
নীলিমাকে। আকাশ চিন্তা করে যদি তাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায়। কিন্ত এতদিন তার বন্ধুরা সব জানতো, আর আকাশকে তার মনের কথা বলতে বলত। কিন্ত আকাশ বলতে চাইতো না। সামনে ভালোবাসা দিবস, তাই আকাশকে তার বন্ধুরা পরামর্শ দেয় এই দিনে তার মনের কথা নীলিমাকে জানাতে। আকাশ ও ঠিক করে যে তার মনের কথা সে এবার তার মনের মানুষকে জানাবেই। কত শত কথা, কত সপ্ন, কত আশা, সব জানাবেই এবার। আকাশ তাই নীলিমাকে ভালোবাসা দিবসে আসতে বলে। আগে কখনও এই দিনে সে বের হয়নি। তাই এবারও সে আসতে চায় না। কিন্ত আকাশ জোরাজুরি করলে বলে যে সে আসবে। তারপর আকাশ চিন্তা করতে থাকে কীভাবে সে তার মনের কথা বলবে। পরে সে সিদ্ধান্ত নেয় যে সে একটা রিং দিয়ে হাঁটু গেরে বসে তার মনের কথা বলবে। যেই ভাবা সেই কাজ। পরের সেই দিনে সে সকালেই চলে গেল যেই স্থানে তাদের দেখা করার কথা। সারারাত আকাশ ঘুমাতে পারে নি কি বলবে সেই কথা চিন্তা করে! সকাল এগারোটায় নীলিমা আসল একটা গেরুয়া রঙের শাড়ি পরে, অনেক সুন্দর করে সেজে এসেছে আজ। কবে জানি আকাশ বলেছিল নীলিমাকে যে গেরুয়া তার প্রিয় রঙ, তাই বোধহয় নীলিমা আজ এই শাড়ি পড়েছে, আকাশ মনে মনে ভাবল সেই কথা। আকাশ আজ চোখ ফেরাতে পারছে না নীলিমার থেকে। নীলিমা জিজ্ঞেস করল, এইভাবে কি দেখছো? আকাশ বলল, কিছু না। পরে আকাশ একগুচ্ছ সাদা গোলাপ আনল, কারণ নীলিমা বলেছিল তার সাদা গোলাপ অনেক পছন্দ। তারপর তার মনের কথা বলার পালা এল।
“তোমার সাথে দেখা তো সেই দুই বছর আগে আশ্বিনে যেদিন তোমার পুরো প্রেমে পড়েছিলাম। শরতের সেই বৃষ্টিভেজা ঘাসের উপমায় তোমাকে খুঁজছিলাম। আমার সারাজীবনের সঙ্গী হবে?” এই কথা বলে হাঁটু গেরে বসে পড়ল আকাশ। এরপর তো নীলিমা আত্মহারা হয়ে গেল আনন্দে, কি বলবে বুঝতে পারছিল না সে! তারপর নীলিমা জবাব দিল, “আমিও তোমার মনের ভেতর থাকতে চাই আজীবন। আমার ভালোবাসার মর্যাদা রাখবে আজীবন?” আকাশ খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলল, “আমি তোমার সাথে আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বাঁচতে চাই। তোমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সাড়ে সতেরো পলক হতে চাই। তুমি থাকবে তো শেষ পর্যন্ত?” তারপর আকাশ তার নিয়ে গোলাপ দিয়ে বলল, “এই গোলাপ এর শুভ্রতার মত পবিত্র আমার তোমার প্রতি যে অনুভূতি। তুমি কি আমার আজীবন সঙ্গী হবে?” নীলিমা গোলাপগুলো হাতে নিল। তারপর আকাশ পকেট থেকে আংটি বের করল। নীলিমাকে পরিয়েও দিল সেই আংটি। এরপর সেই একে অপরের মধ্যে হারানো। তারা এক পলকে একে অপরের দিকে তাকিয়েছিল অনেকক্ষণ। মনে হয় কোনও ঘোর এর মধ্যে আছে তারা! ঘোর কাটল যখন আকাশের বন্ধুরা এসে এই কাহিনী দেখে, অবশেষে হাততালি দিল। তারপর তো সেই রোজ দেখা করা, ঘোরাফেরা করাই ছিল তাদের রুটিন। দেখতে দেখতে কলেজের জীবনের শেষ হয়ে এল। বিদায়ের দিন কলেজে অনুষ্ঠান হবে। সব ঠিকঠাক মত চলছিল। অনুষ্ঠানের দিন সকালে আকাশ অনুষ্ঠানে যাবে তাই তৈরি হবে, সে নীলিমাকে ফোন দিল। ফোনটা ঢুকল না। আকাশ অপ্রত্যাশিতভাবে ভ্যাবাচ্যাকা খেল। সে আবার নীলিমার নাম্বারে ফোন দিল, কিন্ত এবারও ঢুকলো না। সে অন্য নাম্বারে ফোন দিল, তাও ঢুকলো না। আকাশ হাজার বার চেষ্টা করেও নীলিমার খোঁজ পেল। পরে ভাবল, যে অনুষ্ঠান এ গেলে তো দেখাই হবে তাই ফোন দিয়ে আর কি কাজ। সে আজ একটা আসমানী রঙের পাঞ্জাবি পড়ল। নীলিমাই বলেছিল তাকে এই রঙের পাঞ্জাবি পড়তে, আর নীলিমা পড়বে নীল শাড়ি। তাই সে এবারও আকাশ কথামত কাজ করল, সাথে কিনল একগুচ্ছ সাদা গোলাপ। কিন্ত অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল নীলিমা এখনও এল না কেন এই কথা সে ভাবছে এই সময় তার বন্ধুরা এর আড্ডা দিতে। সেও ব্যস্ত হয়ে গেল অনুষ্ঠান দেখতে। সবাই গান, নাচ,কবিতা আবৃত্তি, কমেডি এইসব করছিল। কিন্ত শেষে পালা ছিল নীলিমার, তার আজ গান গাওয়ার কথা। অনেকবার নাম ডাকার পর সে এল না। এবার আকাশ একটু চিন্তিত হল। কেন এল না নীলিমা? অনুষ্ঠান শেষ হলে আকাশ নীলিমার বাড়িতে যায় খোঁজ নিতে, কিন্ত সেখানেও কোনও খবর পেল না সে। তারপর থেকে আর কোনও খোঁজ পায়নি সে। নীলিমার এক বান্ধবী বলেছিল যে, “নীলিমার সাথে আকাশের সম্পর্কের কথা জেনে গিয়েছিল নীলিমার বাবা, তাই পুরো পরিবার বিদেশে চলে গেছে।” কিন্ত সত্যটা কি কেউ জানে না। এই ঘটনার পর থেকে আকাশকে আর কখনওই হাসতে দেখা যায়নি। এখনও সে তার নীলিমাকে খুঁজে বেড়ায় শূন্যের বিচ্ছুরণে। সে এখন ছোটখাটো একটা চাকরি করে জীবন যাপন করে। আর অবসরে সেই নীলিমার কথা ভাবে আনমনে। আর মনের ভিতর থেকে থেকে বলে, তুমি ছিলে আমার সব সুখ,
তুমি ছিলে আমার দুঃখের দুখ!
তুমিই ছিলে আমার অর্ধ আকাশ!
তুমিই ছিলে আমার সেই দুঃখবিলাস,