অমিত কিছুটা বিব্রতবোধ করলো, তার ছোটপু কখনো দোটানায় ভোগে না। সবসময় হাসিখুশি থাকে, সৎ পথে চলার চেষ্টা করে। সেই আপু আজ কাউকে নিজ পরিচয় দিতে সংকোচবোধ করছে! ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগলো অমিতের। কিছুক্ষণ ভাবার পর জিজ্ঞেস করলো,
-‘আপু, লোকটার নাম কি?’
-‘পিথিউশা’
অমিত হাসলো, ব্যঙ্গ করে বললো,
-‘এ্যাঁ, পিথিউশা! এটা কোনো নাম হলো নাকি? আজকালকার দিনে এমন অদ্ভুত নাম কেউ রাখে? নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, মানুষটা গোলমেলে। কেমন সন্ত্রাস টাইপের নাম।’
অরিত্রী কিছুটা বিরক্ত হলো, সঙ্গে রাগান্বিতও।রাগীস্বরে বললো,
-‘কারো নাম শুনে বাজে মন্তব্য করা ঠিক নয় অমিত। পিথিউশা মোটেও মন্দ চরিত্রের মানুষ নন, তার মনটা বড্ড সহজ। সবসময় সেটাই করে যেটা করলে নিজের ভালো হবে পাশাপাশি অন্যের ক্ষতি হবে না। তাছাড়া নামটাই বা মন্দ কোথায়, একটু আনকমন এই যা…’
অমিত মিটিমিটি হাসলো, গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করলো,
-‘তা সে করে কি?’
-‘ফটোজার্নালিস্ট, সাংবাদিক পাড়ায় বেশ নামডাক তার।’
-‘জার্নালিস্ট? আরে ছোটপু, তুই বোকা নাকব হুম? শোন, জার্নালিস্ট মানেই রগে রগে দুর্নীতি। এর ওর ছবি তুলে ব্লাকমেইল করে টাকা কামানোর ধান্ধা। একে তুই ভালো মানুষ বলিস?’
কিছুক্ষনের জন্য অরিত্রীর চেহারা মলিন হলো, তারপর তেজস্বী গলার বললো,
-‘মোটেও না, পিথিউশা অসৎ নয়। উনি সৎ…’
-‘কিন্তু সে তো তোকে বড়পু ভাবছে। ভুলটা ভাঙিয়ে দিলেই পারিস। সৎ হোক কিংবা অসৎ কারো সঙ্গে ছলনা করা তো অন্যায়।’
অরিত্রীর চেহারা কালো মেঘে ঢেকে গেলো, কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো,
-‘আমিও চাই উনি সত্যটা জানুক। কিন্তু…’
অমিত বেশ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-‘কিন্তু কি?’
-‘আমি যদি আমার পরিচয় দেই তবে উনি যদি রাগ করেন? যদি আর কখনো আমার সঙ্গে কথা না বলেন? যদি কখনো আমার মুখদর্শণ করতে না চান? যদি আমাকে মিথ্যেবাদী, ছলনাময়ী ভাবেন?’
অমিত ঠোঁট টিপে হাসে, সে নিশ্চিত তার ছোটপু পিথিউশা নামের লোকটাকে পছন্দ করে, যেনো তেনো পছন্দ না খুব বেশি পছন্দ। নতুবা এতোটা ভাবতো না, সংকোচবোধ করতো না তার ছোটপু। অমিত শান্তস্বরে জিজ্ঞেস করে,
-‘তুই লোকটাকে ভালোবাসিস ছোটপু?’
অরিত্রী বিব্রত হয়, ওড়নার কোনা আঙ্গুলে প্যাচাতে প্যাচাতে ধমকে বলে,
-‘এসব কি কথা অমিত? ওই লোকটাতে আমি ভালোবাসতে যাবো কেনো? কতদিনেরই বা পরিচয় আমাদের?’
-‘যদি ভালো না বাসিস তবে সত্য জানার পর তার প্রতিক্রিয়া কি হবে তা ভেবে ব্যাকুল হচ্ছিস কেনো? উনি সত্য জানার পর তোর সঙ্গে কথা না বললে, তোর মুখদর্শন না করলে ক্ষতি কি? কে সে? তোর জীবনে তার ভূমিকা কি? তার অনুপস্থিতিতে তোর জীবনে কোনো বদল আসার তো কথা না।’
অরিত্রী নিশ্চুপ মেঝের দিকে তাকিয়ে বসে আছে, ওকে চুপ থাকতে দেখে অমিত আবার বলে,
-‘আমরা কখন কোনো মানুষের প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে ভয় পাই জানিস? যখন আমরা কাউকে ভালোবাসি। আমার ক্ষেত্রেই দেখ, মা, বাবা, তুই, বড়পু তোদের আমি ভীষণ ভালোবাসি। তাই কোনো অন্যায় করার আগে ভাবি তোরা জানলে তেদের কেমন লাগবে। এ ভাবনাটাই আমাকে খারাপ কাজ থেকে দূরে রাখে। পিথিউশা নামক লোকটা কি ভাববে, কষ্ট পাবে কি না এসব ভেবে তুই ব্যাকুল হচ্ছিস কারন তার জন্য তোর মনে বিশেষ জায়গা তৈরি হয়েছে। তুই আমার কাছে তোর সমস্যার সমাধানের জন্য এসেছিস,কিন্তু তোর সমস্যার সমাধান তোকেই করতে হবে। কেনো করবি, কিভাবে করবি তাও তোকেই ভাবতে হবে ছোটপু। আমাদের সৃষ্ট সমস্যার সমাধান আমাদের কাছেই থাকে, নিজের মনকে বোঝার চেষ্টা কর। আশা করি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবি। এটুকু মনে রাখিস তোর সিদ্ধান্ত যা’ই হোক, তোর ছোটভাইটা সবসময় তোর পাশে আছে। নিজেকে সময় দে আপু, ভেবে দেখ। নিশ্চয়ই তোর জন্য যেটা বেস্ট সেটাই করবি তুই…’
অমিতের কথাগুলো বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো অরিত্রী, এ মুহূর্তে তার নিজেরও মনে হলো তাড়াহুড়া করা ঠিক হবে না। তাকে ভাবতে হবে, তার অনুভূতি সম্বন্ধে, পিথিউশার অভিব্যক্তি সম্বন্ধে। যদি সত্যিই পিথিউশা অতসীকে ভালোবাসে তবে সে তাদের মাঝে আসবে না। সব সত্যিটা পিথিউশাকে জানানোর পর ওদের মাঝখান থেকে সরে পড়বে। তবে যদি পিথিউশা ব্যক্তি অরিত্রীকে পছন্দ করে তবে নিশ্চয়ই একটা নামের ভুল তার কাছে খুব বড় কিছু হবে না। সে নিশ্চয়ই অরিত্রীকে মেনে নেবে। অরিত্রী সিদ্ধান্ত নিলো, সে প্রথমে পিথিউশার মনের কথা জানার চেষ্টা করবে তারপর সত্যিটা জানাবে। মন ও মস্তিষ্কের দোটানা কাটিয়ে একটা সিদ্ধান্তে আসতে পেরে স্বস্তিবোধ করছে অরিত্রী, নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে অমিতকে ডেকে বললো,
-‘আমার ছোট্ট ভাইটা কবে এতো বুঝদার হয়ে গেলো টেরই পেলাম না। আপু তোর জন্য সবসময় দোয়া করি, অনের বড়-হ ভাই।’
অমিত মুচকি হেসে বোনকে বিদায় জানালো, সে জানে তার ছোটপুর মনটা নরম। এ মানুষটা সবাইকে ভালোবাসতে জানে, কিন্তু আজ অবধি কারো পরিপূর্ণ ভালোবাসা অর্জন করতে পারে নি। অমিত খুব করে চায়, তার ছোটপুর জীবনে এমন কেউ আসুক যে তাকে ভালোবেসে আগলে রাখবে। তাকে কখনো নির্গুনা বলবে না, কারো সঙ্গে তুলনা করবে না। ওই মানুষটার কাছে তার ছোটপু হবে সর্বগুণসম্পন্ন!
১৪
অনেক ভেবে পিথিউশা তার অতীতের স্মৃতির পাতা অতসীর সামনে উম্মোচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই সঙ্গে তার ভালোবাসার কথাও ব্যক্ত করার জন্য মনস্থির করেছে। আজ ইচ্ছে করে সে পাঞ্জাবী পরেছে, সাদা পাঞ্জাবীতে তাকে আরো বেশি আকর্ষণীয় বোধ হচ্ছে। ঘরে ঢুকার সময় পিথিউশাকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঈশান চিৎকার করে বললো,
-‘ভাইয়া, তোকে কি সুন্দর লাগছে! আজ যদি ভাবী থাকতো তবে নিশ্চিত জ্ঞান হারাতো। ছেলে মানুষও এতো সুন্দর হয়!’
পিথিউশা বেশ বিরক্ত হলো, দাঁত কটমট করে বললো,
-‘একটা কমপ্লিমেন্ট করবি তাও সুন্দর করে করতে পারিস না। ছেলেদের সুন্দর বলতে শুনেছিস কাউকে? সুদর্শন পুরুষ বললে তাও সন্তুষ্ট হতাম।’
বেডসাইড টেবিলের উপরে রাখা ফুলদানী থেকে একটা প্লাস্টিকের ফুল হাতে নিয়ে পিথিউশার সামনে এসে দাঁড়ালো ঈশান। তাকে ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করে বললো,
-‘আজ যদি আমি মেয়ে হতাম তবে তোর সামনে হাঁটু ভেঙ্গে বসে বলতাম, হে সুদর্শন পুরুষ, আপনার তেজস্বী রূপরশ্মিতে আমাকে প্রজ্জলিত করুন। আমাকে গ্রহন করুন প্রানপ্রিয়… আমি আপনার পাণিপ্রার্থী হতে চাই। আমাকে এ চরণে স্থান দিন…’
কথা বলতে বলতে পিথিউশার দু’পা জড়িয়ে ধরেছে ঈশান। নিজের পা ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে পিথিউশা বললো,
-‘এ কেমন অশালীনতা ঈশান… কোনো মেয়ে নিজেকে কোনো পুরুষের পায়ে অর্পন করবে কেনো? হোক সে যতোই সুদর্শন, কোনো নারীকে তার আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে কারো জীবনসঙ্গী হবার বাসনা করা উচিত নয়। দিনশেষে আত্মসম্মানই মানুষের শেষ অবলম্বন, হোক সে নারী কিংবা পুরুষ। পা দু’টো ছাড় এবার…’
পিথিউশা উবু হয়ে ঈশানকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছিলো, দুই ভাইয়ের হাতাহাতিতে একসময় দুজনেই মেঝেতে পড়ে যায়। দু’জনের চিৎকারের শব্দে ছুটে আসেন আরজু হক। নিজের দুই ছেলেকে মেঝেতে অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে অনেক চেষ্টা করেও হাসি আটকাতে পারেন নি তিনি। ঈশান মাথায় হাত দিয়ে মেঝেতেই বসে আছে, বিছানার কোনায় মাথা লেগে তার মাথা আলু হয়ে গেছে। অন্যদিকে পিথিউশা কোমর ধরে বিছানায় উঠে বসার চেষ্টা করছে। তার বাঁকানো কোমর আর ছেঁড়া পাঞ্জাবী দেখে আরজু হক নিশ্চিত যে ছেলে তার কোমরে ভালোই চোট পেয়েছে। কোনোরকমে হাসি থামিয়ে তিনি বললেন,
-‘তোরা দু’জন আর কবে বড় হবি? বিয়ে হলে এতোদিনে নিজেরা বাচ্চার বাপ হতি আর এখনো ঝগড়া করছিস? মারপিট করে একটা আরেকটার হাড় গুড়ো করছিস। এসব কেমন অপরিপক্কতা হ্যাঁ? দুটোতে বিছানায় উঠে বস, আমি বরফ নিয়ে আসছি। বিয়ের আগে হাড়গোড় ভেঙ্গে লুলা হলে তোদের বউ-বাচ্চা দেখবে কে?’
বউ-বাচ্চার কথা শুনে ঈশানের মাথাব্যাথা চলে গেলো, সে মাথা থেকে হাত সরিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
-‘মা, একটা বউ এনে দাও। দেখবে আমি ভাইয়াকে একটুও জ্বালাবো না। সারাদিন বউয়ের পেছনে ঘুরঘুর করবো, এমনকি ভাইয়ার আগে তোমাকে নাতি-নাতনী এনে দেবো।’
আরজু হক মুখ ঝামটা মেরে বলেন,
-‘নিলর্জ্জতার সীমা অতিক্রম করে গিয়েছিস তুই ঈশান। ফাটা মাথায় আরেকটা বাড়ি না খেতে চাইলে চুপ কর…’
মায়ের ধমকে চুপ করে গেলো ঈশান, আরজু হক দ্রুত পায়ে ফ্রিজ থেকে বরফ আনতে গেলেন। এ সংসারে সে না থাকলে কবেই ভেসে যেতো, একাহাতে চারজন পুরুষ মানুষকে সামলানো কি চারটেখানি কথা…
অনেক ভাবনা-চিন্তার পর পিথিউশা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো অরিত্রীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলার কিন্তু শেষমেশ আর বের হওয়াই হলো না। পিঠের ব্যথায় সারাটা দিন বিছানায় শুয়েই কাটাতে হলো। রাতেও খুব একটা ভালো ঘুম হলো না তার, বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে রাতটা পার করে দিলো। ফজরের আযান শুনে নামাজ পড়লো, ছাদে গিয়ে সূর্যোদয় দেখলো, তারপর সিদ্ধান্ত নিলো গতদিন যে কথা বলা হয় নি, তা আজ নিশ্চয়ই বলবে পিথিউশা। এই দোটানার ইতি ঘটা জরুরি। মনে মনে পিথিউশা আরো একটা সিদ্ধান্ত নিলো, আজ যতো যা’ই হোক না কেনো ঈশানের মুখদর্শন করবে না সে…
১৫
মাথায় হ্যাট পরা ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে যখন গার্ড শুটিং স্পটে এসে পৌঁছালো অতসীর চোখ তখন কোটর থেকে বের হয়ে আসবার অবস্থা। ডিরেক্টর সাহেব যখন ছেলেটার মাথার হ্যাট সরালেন অতসী তখন শব্দ করে হেসে ফেললো, বহুবছর পর সে এমন মন খুলে হেসেছে। সেট এর অনেকেই তার দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলো। একটা শর্ট ব্রেক নিলো অতসী, তারপর ঈশানের হাত ধরে সবার আড়ালে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-‘নিউ প্রফেশন বুঝি? কি প্রফেশন? চুরি করা?’
একটু থেমে আবার জিজ্ঞেস করলো,
-‘তা এখান থেকে কি চুরি করবেন বলে ঠিক করেছেন? লিপস্টিক? মেকাপ আইটেম? কস্টিউম? নাকি আস্ত লাইট-ক্যামেরা?’
হাসির দমকে কথা বলার সময় বারংবার কাঁপছিলো অতসী, ঈশান অনেক চেষ্টা করেও রাগ সংবরন করতে পারছিলো না। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললো,
-‘চুরি করতে যাবো কেনো? প্রথমবার কাউকে জ্যাকেট পড়তে দেখছেন?’
অতসী হাসে, হাসির রেখা পূর্বের তুলনায় ক্রমশ প্রশস্ত হয়। তার সঙ্গে প্রথমবারের মতো ঈশান লক্ষ্য করে অতসীকে হাসলে দারুণ লাগে। তার চারিত্রিক কাঠিন্য তখন মেঘের মতো উড়ে যায়, তাকে পুষ্পকড়ির মতো সতেজ বোধ হয়।
ঈশানকে নিজের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখে অতসী কিছুটা লজ্জা পায়, লজ্জা ঢাকার জন্য পূর্বের গাম্ভীর্যপূর্ণ স্বরে বলে,
-‘মানছি শেষরাতের দিকে একটু ঠান্ডা পড়ে, এই মৌসুমে মাঝে মাঝে একটু বৃষ্টিও হয় কিন্তু তাই বলে এই রোদের মধ্যে কেউ এমন জ্যাকেট পরে, গলায় মাফলার আর মাথায় হ্যাট পরে ঘুরে না। আপনাকে দেখে দুটো জিনিস মনে হচ্ছে। এক, চোর-বাটপার… দুই, কোনো সাংবাদিক, যে কি না শুটিং সেট এর আশেপাশে ঘুরঘুর করে রগরগে কিছু মশলাদার খবরের জন্য।’
ঈশান হতাশ গলায় বললো,
-‘আমি দুটোর একটাও নই, সত্যি বলতে এসব পরে অনেক গরম লাগছে। কিন্তু…’
অতসী হাসি চেপে আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করে,
-‘কিন্তু কি?’
ঈশান মাথা থেকে গলা পর্যন্ত পেছানো মাফলারটা খুলে অতসীকে নিজের মাথার ফোলা জায়গাটা দেখালো, তারপর নিস্তেজ গলায় বললো,
-‘আপনার হবু বরের সুনাম করার পুরষ্কার। মাথায় এমন আলু নিয়ে রাস্তায় বের হই কি করে বলুন? আমার মতো বেকারের আছে বলতে তো এই ফাস্টক্লাস চেহারাটাই তাই না? সেটাও যদি চলে যায় তবে কপালে বউ জুটবে বলুন?’
চলবে….