আসন্ন ঈদ-উল-আজহাকে সামনে রেখে সবার বাড়িতেই চলছে প্রস্তুতি। এই ঈদে অন্যান্য আনন্দের আয়োজন থাকলেও ভোজনই যেনো মূল আকর্ষণ। কোরবানীর মাংস খাওয়া ধর্মীয় রীতিরই অংশ। গরু বা খাসি কোরবানী হওয়ায় প্রতিবেলার আয়োজনেই এই গরু বা খাসির মাংসের তৈরি বিভিন্ন রকম খাবার উপস্থিত থাকে। ঈদ উপলক্ষে তৈরি মজাদার মুখরোচক খাদ্য নিজের বাড়ি, এবাড়ি-ওবাড়ি মিলিয়ে খাওয়াও হয়ে যায় একটু বেশিই। উৎসবের খাবার, তাই তেল-মসলা, ঘন দুধ, ঘী, মাখন এর ব্যাবহারো হয় প্রচুর। আবার আবহাওয়ার বিরূপতাও রয়েছে এই সময়টাতে। একদিকে যেমন প্রচন্ড গরম ও আর্দ্র আবোহাওয়া বিরাজ করছে, তেমনি হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টিও হচ্ছে এই মৌসুমে। ফলে পরিবেশগত কারনে অসুস্থ হওয়ার কিছুটা ঝুকি তো রয়েছেই, তার পাশাপাশি ঈদের এই আয়োজনে অতিভজনে ও গুরুপাক খাদ্য গ্রহনেও অসুস্থতার সম্ভাবনা থাকছে। ঈদে অনেককেই বদহজম, বুক জ্বালাপোড়া, গ্যাস হওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, আমাশয় ইত্যাদি সমস্যায় ভূগতে দেখা যায়।
আনন্দঘন এই সময়টাতে আমরা যেনো সুস্থ্য থেকে পুরোটা সময় উৎসব উপভোগ করতে পারি সে জন্য সাবধানতার কিছু টিপস যা আমাদেরকের কোরবানীর ঈদের এই সময়টাতে সাস্থ্যহানী ব্যাতীরেকে মজার খাবারগুলো উপভোগ করতে সহায়তা করতে পারেঃ
১। একবারে অনেক খাবার না খেয়ে অল্প অল্প করে বারে বারে খাওয়া যেতে পারে। ঈদে যেহেতু নিজ গৃহের পাশাপাশি আত্মীয় পরিজনদের বাড়িতে বেড়ানো এবং খাওয়া হয় ফলে অনিচ্ছা সত্তেও অতিভোজনের ঝুকি থাকে। তাই প্রতিবারই খাদ্যের পরিমাণ কম রাখতে পারলে কিছুটা ঝুকি এড়ানো সম্ভব হবে।
২। দৃশ্যমান চর্বি ফেলে দিয়ে মাংস রান্না করতে হবে। মাংস রান্নার আগে ছোট ছোট টুকরা করে কেটে নিলে বাহ্যিক চর্বির অংশ কেটে ফেলে দেওয়া যেমন সহজ হবে তেমনি পিছ ছোট ছোট হওয়ায় খাওয়ার পরিমান ও নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে।
৩। কম তেলে রান্না করতে হবে। কোরবানীর মাংসের পরতে পরতে চর্বি থাকে, তাই রান্নায় বাড়তি তেলের তেমন প্রয়োজন পরে না। অতি সামান্য উদ্ভিজ্জ তেল ব্যাবহার করে রান্না করলে স্বাদ ও স্বাস্থ্য উভয়েই বজায় থাকবে। ঘী, মাখন ব্যাবহার বর্জন করতে হবে।
৪। প্রতিবেলার খাবারে সবজির উপস্থিতি থাকতে হবে। মাংস জাতীয় খাবার হজম ও পরিপাক তন্ত্রের সুস্থতার জন্য এর সাথে সবজি ও সালাদ খাওয়া জরুরী। ঈদে অতিরিক্ত মাংস ও জটিল পাচ্য খাবার খাওয়ায় বিভিন্ন ধরনের পেটের পীড়া দেখা দিতে পারে। তাই এর সাথে যথেষ্ট পরিমান সবজি ও সালাদ খেলে একদিকে যেমন মাংস কম খাওয়া হবে অপরদিকে তা কোষ্ঠ্যকাঠিন্যও পেটের পীড়া প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।
৫। গরু বা খাসির কিছু অংশের মাংসে চর্বির পরিমান বেশি থাকে, আবার কিছু অংশে চর্বি কম থাকে। যাদের উচ্চ রক্তচাপ বা হজমের সমস্যা আছে তাদের কম চর্বিযুক্ত অংশ খাবার চেষ্টা করতে হবে।
৬। গরু বা খাসির মাংস ব্যাতিরেকে বাকি অংশ সমূহ যেমন- কলিজা, মাথা, মগজ, ভুরি অতি উচ্চ কোলেস্টেরল সমৃদ্ধ। একমাত্র বাড়ন্ত শিশু ব্যাতীত সকলেরই এইসব অংশ নিজের ব্যাক্তিগত স্বাস্থ্য ঝুঁকি বুঝে এড়িয়ে চলা বাঞ্চনীয়।
৭। রন্ধন পদ্ধতির উপরেও খাদ্যের সাস্থ্যকর বা অসাস্থ্যকর উপাদানের পরিমান নির্ভর করে। মাংসের ট্রেডিশনাল রান্নার তুলনায় গ্রিল করলে বেশি সাস্থ্যকর হয়। রান্নার আগে সিরকা বা লেবুর রস দিয়ে মাংস মেরিনেট করে রান্না করলে তা যেমন উপাদেয় হয়, তেমনি রন্ধকালীন ক্ষতিকর উপাদান তৈরির ঝুকি কমে আসে। ভূনার পরিবর্তে শুকনা কাবাব করা যেতে পারে। এতে চর্বির পরিমাণ কম থাকে এবং ঝোলের সাথে আলাদা তেল মসলা গ্রহণের ঝুঁকিও কম হয়।
৮। মাংসের সাথে খাবার জন্য পোলাউ, বিরানী না করে সাদা ভাত বা রুটি রাখলে সেটা যেমন সহজে হজম যোগ্য হবে তেমনি টোটাল ক্যালরীও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
৯। খাবার পরে মিষ্টি জাতীয় ডেসার্ট না রেখে ফল রাখা যেতে পারে।
১০। খাবারের সাথে কোক-সেভেনাপ না রেখে টক দই এর শরবত রাখা সাস্থ্যসম্মত হবে।
১১। প্রতিদিনকার শরীরচর্চাকে ঈদ উপলক্ষে ছুটি না দিয়ে চেষ্টা করতে হবে কিছু সময় বেশি হাটার।
মাংসে প্রচুর পরিমাণে আমিষ, খাদ্য আঁশ এবং বিভিন্ন রকমের ভিটামিন, আয়রন ও অন্যান্য মিনারেলস এর পর্যাপ্ত উপস্থিতির কারনে এটি একদিকে যেমন খুবই উপকারী, আবার এর উচ্চ চর্বির উপস্থিতির কারনে এর অতিভোজনে ঘটাতে পারে সাস্থ্যহানী। এই দ্বিমুখীনীতির সামঞ্জস্য করনের উপায় হল পরিমিত গ্রহণ। সারাদিনে ৭৫-১০০ গ্রাম এর বেশি এই মাংস গ্রহণ না করাই শ্রেয়। ঈদে মজার খাবার খেতে আমাদের ধর্মেই বলা আছে, আবার উদর পূর্তি করে না খেতেও বলা আছে। তাই আসুন আমরা পরিমিত আহার করার চেষ্টা করি এবং সুস্থ্য থাকি।
সানজিদা শারমীন
সিনিয়র ক্লিনিকাল ডায়েটিশিয়ান


