দর্শনীয় স্থান: লালন শাহের আখড়া
লেখিকা: জেরিন জাহান দিশা
বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার ছেউড়িয়া গ্রামে অবস্থিত লালন শাহের আখড়া শুধু একটি দর্শনীয় স্থান নয়, এটি বাঙালির আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক উজ্জ্বল প্রতীক। ফকির লালন শাহ ছিলেন একজন কিংবদন্তি বাউল সাধক, সমাজ সংস্কারক ও দার্শনিক। তাঁর জীবন, গান ও দর্শন মানুষকে শিখিয়েছে জাত-ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে মানবতাকে ভালোবাসতে।
লালন শাহের জীবন ও দর্শন
লালন শাহের জন্ম ১৭৭৪ সালে হলেও তাঁর সঠিক জন্মতারিখ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। তিনি ছোটবেলায় একবার মারাত্মকভাবে অসুস্থ হলে এক মুসলিম পরিবার তাঁকে উদ্ধার করে লালন বানান। সমাজ তাকে বর্জন করলেও তিনি সবধরনের বৈষম্যকে অস্বীকার করে ভালোবাসা ও মানবতার বাণী ছড়িয়ে দেন। তাঁর গানগুলো বাংলা লোকসংগীতের ইতিহাসে এক অমূল্য সম্পদ। “সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই”—এই বিশ্বাসই তাঁর দর্শনের মূল ভিত্তি।
আখড়া ও মাজার
ছেউড়িয়া গ্রামে অবস্থিত লালন শাহের আখড়া ও মাজার প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী ও ভক্তের পদচারণায় মুখর থাকে। এখানে আছে লালন একাডেমি, একটি জাদুঘর, অডিটোরিয়াম, তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র—যেমন জলচকি, ঘটি-বাটি, দরজা, এবং চিত্রকর্ম। প্রবেশের জন্য সামান্য টিকিট কাটতে হয়, এবং প্রাঙ্গণটি সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা হয়।
আখড়ার ভেতরেই আছে একতারার এক বিশাল ভাস্কর্য ও লালনের আবক্ষ মূর্তি, যা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন। যারা লোকসংগীত ও ইতিহাস ভালোবাসেন, তাঁদের জন্য এটি এক চিরস্মরণীয় স্থান।
লালন মেলা: উৎসবের রঙে আধ্যাত্মিকতা
প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা ও কার্তিক মাসের প্রথম দিনে লালন স্মরণে বসে বিশেষ মেলা। ফাল্গুনের দোলযাত্রার সঙ্গে বসন্ত উৎসবও যুক্ত হয়। আর ১৭ অক্টোবর পালিত হয় লালনের মৃত্যুবার্ষিকী। এই সময়ে আখড়া প্রাঙ্গণ হয়ে ওঠে বর্ণিল আলোকসজ্জায় সজ্জিত এক উৎসবমুখর জায়গা। গ্রামীণ মেলায় বিক্রি হয় হস্তশিল্প, পাঁপড়, খই, জিলাপি, রস ও লালনের গানের সিডি।
রাতে আয়োজিত হয় বাউল গানের আসর, যেখানে দেশ-বিদেশের শিল্পীরা এসে গান পরিবেশন করেন। বাউলদের একতারা ও মনের সুর দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে রাখে।
বিদেশিদের আকর্ষণ
লালনের জীবনদর্শন কেবল দেশেই নয়, বিদেশেও ব্যাপকভাবে আলোচিত। ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপানের বিভিন্ন গবেষক ও ভক্ত ছেউড়িয়ায় এসে গবেষণা করেন এবং অনেকেই এখানে বসবাস শুরু করেছেন। কেউ কেউ স্থানীয়দের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কেও আবদ্ধ হয়েছেন। লালনের গান ও দর্শন বাংলাদেশকে বিশ্বের সাংস্কৃতিক মানচিত্রে মর্যাদার আসনে বসিয়েছে।
আশেপাশের দর্শনীয় স্থান
লালনের আখড়া ভ্রমণের পাশাপাশি দর্শনার্থীরা কুষ্টিয়ার আরও কিছু ঐতিহাসিক স্থান ঘুরে দেখতে পারেন। এর মধ্যে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহ কুঠিবাড়ি, মীর মোশাররফ হোসেনের বাস্তুভিটা, ও গড়াই নদীর রেনউইক বাঁধ। প্রতিটি স্থানেই রয়েছে সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক মূল্য।
থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা
কুষ্টিয়া শহরে ভ্রমণকারী পর্যটকদের জন্য হোটেলও রয়েছে। শাপলা চত্বর, মজমপুর গেট, চৌড়হাস মোড় ও এন.এস. রোডে ৩৫০ থেকে ৬০০ টাকার মধ্যে ভালো মানের আবাসিক হোটেল পাওয়া যায়। খাওয়ার জন্য কোর্ট স্টেশন এলাকার হোটেলগুলোর খাবার রুচিশীল ও মানসম্মত।
ফকির লালন শাহ শুধু একজন সাধক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একটি দর্শনের নাম। তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে ভালোবাসা, মানবতা ও সত্যের পথে চলা যায়। তাঁর আখড়া আজও সেই দর্শনের প্রতীক হয়ে মানুষের হৃদয়ে অনুরণন তোলে। যারা জীবনে একটুখানি নিরবতা, সুর, ও আত্মিক স্পর্শ খোঁজেন—তাঁদের জন্য লালনের আখড়া এক অনন্য গন্তব্য। এখানে এসে মন ও আত্মার এক গভীর সংযোগ ঘটে, যা জীবনের দৈনন্দিন কোলাহল থেকে মুক্তি দিয়ে মানুষকে নতুনভাবে ভাবতে শেখায়। এই আখড়া কেবল দর্শনীয় স্থান নয়, এটি এক নিরব পাঠশালা, যেখানে জীবন ও প্রেমের আসল মানে উপলব্ধি করা যায়। তাই লালন শাহের আখড়া ভ্রমণ শুধু চোখের নয়—এটি আত্মারও এক পরম ভ্রমণ।
*লালন শাহের মাজার নিজ চোখে দর্শন না
করলে বোঝা যাবে না।জায়গাটিতে লালন
শাহ নামে একজন সাধক ছিলেন। বহু পর্যটক
লালন কে নিয়ে গবেষণা করে চলেছে। লালন
শাহের এই মাজার দর্শন করতে বহু মানুষের
আনাগোনা হয়। কেউ কেউ লালন শাহ কে নিয়ে
লিখতে ব্যস্ত। লালন শাহ তার বহু বাণীতে
উল্লেখ করে গেছেন জাত নিয়ে বড়াই না করতে।
বিভিন্ন মানুষ লালন এর মাজার দর্শন করার জন্য
নিজের ডায়রি নিয়ে আসে। লালনের মাজারগুলো
ঘুরে ঘুরে দেখে।পরে সেগুলো নোট করে নিজের
কাছে রেখে দেয়।
উপসংহার:লালন শাহ ১৭ই অক্টোবর ১৮৯০সালে
নিজের ছেউড়িয়াতে মৃত্যু বরন করে। মৃত্যু কালীন
তার বয়স ১১৬বছর।