Close

কুসংস্কারের সমাজে শিক্ষার আলোর অভাব

লেখিকা: জেরিন জাহান দিশা

আমরা নিজেদের আধুনিক বলি, শিক্ষিত দাবি করি। কিন্তু বাস্তবে একটু গভীরে তাকালেই দেখি—আজও আমাদের সমাজ কুসংস্কারের অন্ধকারে বন্দি। শিক্ষার আলো ছড়ালেও চিন্তার জানালা অনেকেরই এখনো বন্ধ।

আমি নিজের চোখে দেখেছি—নবজাতককে হাসপাতালে নিয়ে আসার সময় অনেকে সঙ্গে করে ঝোড়ের পাতা বা “আসসড়া” নিয়ে আসে। কারণ জানতে চাইলে বলে, “জ্বিন-ভূতের হাত থেকে বাঁচাতে।” অথচ এসব পাতার বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই।

আঁতুড় ঘরে দেখা যায়—শিশুকে গরম হাতে স্যাক দেওয়া হচ্ছে, বিশেষ করে মাথায়। এটি শিশুর কোমল ত্বকে ক্ষতি করতে পারে। কেউ কেউ আবার বাচ্চার চোখে কালি লাগান, যেন চোখ বড় হয়! অথচ হোমিও ডাক্তারদের মতে, এসব কালি পরে গলায় নাক দিয়ে বের হতে পারে, যা শিশুর জন্য ক্ষতিকর।

এখন আসা যাক সমাজে প্রচলিত কিছু কুসংস্কারের কথায়—

১. নজর লাগা
সন্তান একটু অসুস্থ হলে বাবা-মা বলেন, “নজর লেগেছে।” শুরু হয় লঙ্কা পোড়ানো, ডিম ঘোরানো, ঝাড়ফুঁক। অথচ শিশুর দরকার হতে পারে বিশ্রাম আর পুষ্টিকর খাবার।

২. ভূতে ধরা বা জিনের আসর
কেউ মানসিক সমস্যায় ভুগলে বলা হয়, “জিন ধরেছে”। তখন ডাক পড়ে ওঝা-কবিরাজের। চলে তাবিজ-কবচ আর ঝাড়। অথচ এসব উপসর্গ মানসিক রোগের ইঙ্গিত, যার জন্য প্রয়োজন চিকিৎসা, জ্বিন তাড়ানো নয়।

৩. ঋতুস্রাব নিয়ে কুসংস্কার
অনেক গ্রামে আজো মেয়েরা ঋতুকালে রান্নাঘরে ঢুকতে পারে না, কিছু স্পর্শ করতে পারে না। বলা হয়, “তুমি অপবিত্র।” এই ধারণা কেবল শরীর নয়, মনকেও আঘাত করে।

৪. গাছ কাটার কুসংস্কার
শিমুল বা কদম গাছ কাটার আগে দুধ ঢালা, দোয়া পড়া—এইসব অলৌকিক বিশ্বাস আজো টিকে আছে। প্রকৃতি রক্ষা জরুরি, কিন্তু গাছকে জিন-ভূতের বাসা ভাবলে বিজ্ঞানচর্চা বাধাগ্রস্ত হয়।

৫. স্বপ্ন মানেই অমঙ্গল
স্বপ্নে মৃত স্বজনকে দেখলে কেউ কেউ সারাদিন কিছু খায় না, কথা বলে না—ভাবেন অমঙ্গল হবে। অথচ স্বপ্ন মানসিক অবচেতন অবস্থার প্রকাশ, কোনো ভবিষ্যদ্বাণী নয়।

৬. সন্তান না হলে মেয়ের দোষ
আজও অনেক পরিবারে সন্তান না হওয়ার দায় মেয়ের ওপর চাপানো হয়। তাকে তাবিজ-কবচ পড়ানো হয়, অপবাদ দেওয়া হয়। অথচ চিকিৎসাবিজ্ঞান বলে—এই সমস্যার জন্য নারী ও পুরুষ উভয়ই দায়ী হতে পারেন।

৭.অন্ধ বিশ্বাস

অনেকে আছেন, যাঁরা মনের আশা পূরণ করার জন্য ঘাটে দুধ ঢেলে আসেন। বলেন, “ইচ্ছা পূরণ হলে আবার দুধ দেব।”
আবার দেখা যায়—বাড়িতে কেউ মারা গেলে, দাফনের পরের দিন বলা হয়: “পারঘাটে টাকা আর গামছা দিতে হবে। কারণ মৃত ব্যক্তি যদি সেকালে ঘাট পার হতে গিয়ে টাকা না পায়, তাহলে বিপদে পড়বে।”

৮. ধর্মীয় কুসংস্কার
অনেক পরিবারে দেখা যায়—সন্ধ্যায় আজান দিলে তৎক্ষণাৎ দরজা খুলে দিতে হবে, না হলে নাকি ফেরেশতা ঘরে ঢুকতে পারবেন না। আবার কেউ বলেন, ঘরে বাঘ বা হাতির ছবি থাকলে নামাজ হয় না। অথচ ইসলাম শিক্ষা দেয়—নামাজে মনোসংযোগ, একাগ্রতা ও অন্তরের পবিত্রতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ বলেছেন, “ইবাদাতের সময় আমার ধ্যানে মগ্ন হও।” কিন্তু অনেকেই সরাসরি ছবিকে সমস্যা মনে করে, অথচ ঘরের শিশুর খেলনার পেছনেও পর্দা টানিয়ে রাখে! বিষয়টি ধর্ম নয়, ভুল ব্যাখ্যার ফল।

৯. সন্ধ্যায় ঝাড়ু দিলে অমঙ্গল হয়

অনেক বাড়িতেই এখনো বলা হয়—“সন্ধ্যায় ঘর ঝাড়ু দিও না, এতে ঘরের সম্পদ চলে যায়, অমঙ্গল হয়।” কেউ কেউ বলেন—“ধুলা ফেললে লক্ষ্মী রাগ করেন।” অথচ বাস্তবতা হলো, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইসলামসহ সব ধর্মেই প্রশংসিত। সন্ধ্যায় ঝাড়ু দিলে অমঙ্গল নয়, বরং ঘর থাকে জীবাণুমুক্ত ও সুস্থ পরিবেশে ভরা। এই ধরনের ভুল ধারণা আমাদের স্বাস্থ্যচর্চা এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভ্যাসকেও বাধা দেয়।

১০. সন্ধ্যাবেলায় গরুর দুধ দোয়া যাবে না
অনেকে বিশ্বাস করেন—সন্ধ্যাবেলায় গরুর দুধ দোয়ালে অমঙ্গল হয়, জ্বিন খেয়ে ফেলে বা দুধ ‘অশুদ্ধ’ হয়ে যায়! অথচ বাস্তবতা হলো—গরুর শরীরবিজ্ঞান বা দুধের গুণগত মানের সঙ্গে সময়ের কোনো সম্পর্ক নেই। বিজ্ঞান বলে, নির্দিষ্ট সময় পরপর দুধ দোয়াই স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী এবং গরুর স্বস্তির জন্যও ভালো।

১১.শনি ও মঙ্গলবার বাঁশ কাটা যাবে না
“বাঁশ কাটলে অমঙ্গল হবে”, “পরিবারে মৃত্যু হতে পারে”—এমন ভয় এখনো অনেকের মনে গেঁথে আছে। অথচ প্রকৃতিতে বাঁশ কাটার সময় নির্ধারণ হয় কৃষি ও পরিবেশগত কারণে, গ্রহ-নক্ষত্র বা বার দিন দেখে নয়। এ ধরনের বিশ্বাস সমাজে ভয় ঢুকিয়ে দেয়, যুক্তিকে ধ্বংস করে।

এগুলো দেখে মনে হয়—মানুষ বাহ্যিক আচরণ নিয়ে যতটা ব্যস্ত, অন্তরের বিশুদ্ধতা নিয়ে ততটা সচেতন নয়। ধর্মের মূল বার্তা ভুলে গিয়ে বাইরের বিষয় নিয়ে টানাটানি করছে, যেখানে প্রয়োজন ছিল—আত্মশুদ্ধি ও সঠিক বোঝাপড়া।

কেউ মারা গেলে অনেক সময় পরিবারের মেয়ে বা ছেলে সদস্যরা কোরআন শরীফ বুকে নিয়ে ছোটে, যদিও অনেকেই ঠিকমতো পড়তে জানেন না। অথচ এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে জরুরি—অসুস্থ ব্যক্তির সামনে সুন্দরভাবে কোরআনের আয়াত তিলাওয়াত করা, যেন তিনি আল্লাহর বাণী নিজের কানে শুনে শান্তি পান।

এইসব কুসংস্কার আমাদের সমাজকে পিছিয়ে দেয়। ব্যক্তি বিশেষের সমস্যা নয়, এটি একটি সামাজিক ব্যাধি। আমরা যতই শিক্ষিত হই না কেন, যদি যুক্তির চর্চা না করি, তবে অন্ধ বিশ্বাসই আমাদের চালাবে।

সমাধান একটাই—সচেতনতা।
শিক্ষা মানে শুধু ডিগ্রি নয়, চিন্তার স্বাধীনতা। প্রশ্ন করার সাহস, যুক্তির আলোয় ভাবার অভ্যাস—এই গুণগুলোই সমাজকে কুসংস্কারের অন্ধকার থেকে মুক্ত করতে পারে।

নাম: মোছাঃ শিরিনা খাতুন সম্পর্ক:মাতা গ্রাম: বড়বাড়ীয়া পুরাতন হাট পাড়া থানা: মিরপুর জেলা: কুষ্টিয়া মোবাইল:01743281966

One Comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

One Comment
scroll to top