Close

এক ফোঁটা পানি

1608166486 5fdaac56c0bce tears 1


Zerin Jahan Disha

কুষ্টিয়ার এক ছোট্ট গ্রাম খলিশাকুন্ডি।গ্রামের শেষপ্রান্তে ছিলো এক পুরানো স্কুল।খলিশাকুন্ডি মাধ্যমিক বিদ্যালয়।এই স্কুলেই পড়তো আনিচ আর সাজুল। দুজনের বন্ধুত্ব ছিল চোখে পড়ার মতো।সকাল হলে দুজনে একসাথে স্কুলে যেতো, টিফিন শেয়ার করতো।আবার দুপুরে একসাথে মাঠে খেলতো।
শুধু বন্ধুত্ব নয় প্রতিযোগিতা ও ছিলো সমানে সমান। পরীক্ষার
আগে কেউ কাউকে নোট দিতো না
মুখে বলতো দোস্ত পড়া হয়নি। কিন্তু ভিতরে ভিতরে চলতো হাড্ডাহাড্ডি প্রস্তুতি।
সবচেয়ে মজার বিষয় রেজাল্টে সবসময় দুজনেই সমান সমান নম্বর পেতো।সাজুল গান গাইতো অপূর্ব কন্ঠে।কোনো অনুষ্ঠানে মানেই সাজুলের গান।আর আনিছ
ছিল হাসির রাজা । স্কুলের স্টেজে তার কৌতুক শুনে হেসে কুটি কুটি হতো সবাই। একদিন সাজুর হঠাৎ বলে বসে দোস্ত জানিস? আমি বড় ডাঃ হবো।আনিচ বলে তাহলে আমিও হবো কিন্তু হোমিওপ্যাথি ডাক্তার হবো।সাজুল মুখ বাঁকিয়ে বলে ওগুলো কি ডাক্তারি রে! পানি খাইয়ে চিকিৎসা করে?
আনিচ হাসে কিছু না বলে আকাশের দিকে তাকায়। ঘুড়ির লেজ বাতাসে ওড়ে। স্কুলের গন্ডি
পেরিয়ে দুজনে ডাক্তারি তে ভর্তি হলো।সাজুল হলো কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজে।আর আনিচ
হলো কুষ্টিয়া হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।দুজনে একি ম্যাচে থেকে। পড়াশোনা করতে লাগলো। দুজনের লক্ষ্য এখন আলাদা ।সাজুল বড় ডাঃ হ‌ওয়ার জন্য লক্ষ্য স্থির করে ব‌ই নিয়ে পড়াশোনা করছে।আর আনিচ
একটু আলাদা।তার চোখে ধরা পড়তো ঘাসে শিশির জমার সৌন্দর্য মানুষের দুঃখের গভীরতা । তাদের মাঝে বন্ধুত্বের টান আগের মতোই অটুট ছিল কিন্তু ধীরে ধীরে সময়ের ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট দূরত্ব জন্ম নিতে লাগলো। একদিন সাজুল আনিচের ওপর রেগে গিয়ে বলে তুই সারাদিন কি করিস বলতো পানি আর চিনির নাম মুখুস্ত
করিস। আর বলিস ডাঃ হবি।আনিচ হেসে বলে। শোন ভাই আমি মানুষকে শুধুই শরীর দিয়ে দেখিনা। মনের চিকিৎসা ও দরকার হয়।আর হোমিওপ্যাথি কিন্তু মনের দিকটাই বেশি গুরুত্ব দেয়।
সাজুল চোখ বড় বড় করে বলে হাস্যকর তুই জানিস ওগুলো placebo effect এক ফোঁটা পানি খাইয়ে কিছু হয়না।তুই সময় নষ্ট করছিস।আনিচ এবার হাসেনা।ধীরে ধীরে বলে ঠিক আছে সময়‌ই বলবে কে ঠিক কে ভুল।বছর ঘুরে গেল।সাজুল কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজে চ্যান্স পেয়ে গেলো।
দুজনেই দুজনকে নিয়ে ব্যস্ত।সাজুল ইন্টার্নশিপ শুরু করেছে।মাথা গোঁজার সময় নেই-একটার পর একটা রোগী,টানা ডিউটি,রাতভর‌ ওয়ার্ডে ছুটে চলে।সাজুল এখন ডাঃ সাজুল হাসান, নামের পাশে‌ যোগ হয়েছে এম.বি.এস.(কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ) পরিবারের গর্ব আশেপাশের মানুষের ভরসা । অন্যদিকে আনিচ নিজ গ্রাম
খলিশাকুন্ডিতে বাড়িতেই চেম্বার খুলেছে গ্রামের মানুষজনের জন্য সহজলভ্য হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা নিয়ে। সাইনবোর্ডে লেখা আনিচ হোমিও হল।আনিচ একদিন বিকেলে বসে ছিল চেম্বারে তখন সাজুল ফোন করে বলে দোস্ত তোমার চেম্বার কেমন চলে।রোগী-রোগিনী আসে নাকি বসে বসে মাছি তাড়াও।আনিচ এই কথাই কষ্ট পাই কিন্তু
সে নীরবে কষ্ট হজম করে নেই।আনিচ সাজুলকে বলে তোমার চেম্বার কেমন চলছে
সাজুল বলে ভালোই চলছে। একটু ও জিরোবার সময় নেই।যাই হোক বন্ধু আনিচ
তোমাকে একটা কথা বলি।ঔই চেম্বার তুমি চালাতে পারবেনা।কেউ এই তোমার পানি ঔষধে বিশ্বাস করেনা। তুমি চেম্বার না চালাতে
পারলে।মুদি দোকান দিয়ে বসো।তাও একটু
লোকজন আসবে। তারপর সাজুল বলল আচ্ছা বন্ধু ভালো থাকো।আনিচো বন্ধুর ফোনের এই টিটকারি কথা শুনে মন খারাপ করে রেখে দেই। গ্রামের লোকেরা যারা হোমিওপ্যাথি বিশ্বাস করতোনা অনেক ব্যঙ্গ
করতো আনিচকে এবং তার চিকিৎসা জগত নিয়ে।আনিচ শুধু ধৈর্য ধরে বসে থাকতো । কিন্তু ধীরে ধীরে সময়টা বদলাতে লাগলো।যেসব রোগীরা বড় বড় ডাক্তারের চিকিৎসায়
সুস্থ হচ্ছিল না,তারাও ফিরে এলো সুস্থ হয়ে আনিচের চেম্বার থেকে।সাজুলের দিনগুলো চলছিল হাসপাতালের কাজ,রোগী দেখা , রিপোর্ট চেক করা হঠাৎ এক বিকেলে ঝড় আর বৃষ্টি।সাজুলের জ্বর চলে আসে।সাজুল
থার্মোমিটারে জ্বর মেপে দেখলো ১০৪ ডিগ্রি জ্বর সে ঔষধ খাই বিভিন্ন ডাক্তারের পরামর্শ নেই জ্বর কিছুতেই কমেনা। রক্ত পরীক্ষা করল। রিপোর্ট কিছু স্পষ্ট হলোনা।এভাবে কেটে যায় পাঁচটা দিন।সাজুল বিছানায় শুয়ে
কাতরাতে থাকে আর তার কাছের বন্ধু আনিচ কে নিয়ে ভাবতে থাকে। ছোটবেলার সব স্মৃতি মনে করতে থাকে।সাজুল আনিচ কে ফোন করে তার সমস্যার কথা খুলে বলে আনিচ তার বন্ধু কে বলে সে যেন তার চেম্বারে আসে ।সাজুল অনিচ্ছা থাকলেও তার বন্ধু আনিচের কাছে গিয়ে তার জ্বরের
লক্ষণ বলতে থাকে।আনিচ বন্ধু সাজুলকে জ্বরের এক সপ্তাহের ঔষধ দেই। তারপর সাজুল বন্ধু আনিচের কাছে বিদায় নিয়ে চলে
আসে।বাড়ি ফিরে সাজুল ঔষধ খাই। ঔষধ খেয়ে সাজুল সুস্থ বোধ করে।সাজুল ভাবতে
থাকে যে বড় বড় অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তারের পরামর্শ নিলাম। তাদের কথা শুনে দামি দামি
ঔষধ খেলাম কিন্তু উপকার পাইলাম না।আর
হোমিওপ্যাথি ঔষধ মাত্র ১০ ফোঁটা খেয়েই আমি সুস্থ।আমি আমার প্রাণ প্রিয় বন্ধু আনিচকে কতো ছোট করেছি।বলেছি চেম্বার
না চললে মুদি খানার দোকান খুলতে।পানি
ঔষধে কাজ হবেনা।নিজে নিজেই সাজুল অনুতপ্ত হয় নিজের ভুল বুঝতে পারে। তারপর সাজুল বন্ধু আনিচ কে ফোন করে
সে এখন অনেক সুস্থ আর তার জ্বর আসেনি।
আনিচ শুনে খুব খুশি হয়।সাজুল বলে বন্ধু আমাকে ক্ষমা করে দিও। অনেক ছোট করেছি তোমাকে। তোমার চিকিৎসা জগতকে।আমি ভুল ছিলাম বন্ধু আমি জানতাম চিকিৎসা জগত মানে কেবল বড়
নাম বা আধুনিক যন্ত্র না, মমতা আর হৃদয়ের
ছোঁয়াও লাগে।আনিচ তখন বলল তুমি যে তোমার ভুল বুঝতে পেরেছো এটাই অনেক।
তবে কাউকে তার চিকিৎসা নিয়ে ছোট করবেনা। কখন কার হাত যশ হবে কেউ বলতে পারবেনা। কিছু রোগে হাজারো বড় বড় ট্যাবলেট ক্যাপসুলে কাজ হয়না।আবার
দূর্বা ঘাস খেয়ে সেই ব্যক্তি সুস্থ হয়ে যাই। তারপর দুজন বন্ধু আবার এক হয়ে গেলো।

images (3)

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Leave a comment
scroll to top