শিক্ষা কেবল তথ্য আহরণ বা পরীক্ষায় ভালো ফল করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রকৃত শিক্ষা হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া, যা মানুষের চিন্তা, মনন এবং মূল্যবোধকে শাণিত করে, তাকে যুক্তিনির্ভর ও মানবিক করে গড়ে তোলে। এই লক্ষ্য পূরণে যে কয়টি কার্যকর উপায় রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো বিতর্ক চর্চা। বিতর্ক শুধুমাত্র মঞ্চে দাঁড়িয়ে কথা বলার বিদ্যা নয়, এটি যুক্তির আলোকে চিন্তা করার, যুক্তি প্রদর্শনের এবং ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার একটি প্রশিক্ষণ। একজন প্রাক্তন বিতার্কিক হিসেবে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, বিতর্ক চর্চা শিক্ষার্থীদের মননশীল বিকাশে এক অনন্য ভূমিকা পালন করে। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা এমন একটি বয়স অতিক্রম করে, যেখানে তাদের মানসিক বিকাশ, দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যক্তিত্ব গঠনের ভিত্তি তৈরি হয়। এই সময়ে যদি তাদের যুক্তিবোধ, বিশ্লেষণক্ষমতা ও আত্মপ্রকাশের দক্ষতা উন্নয়নে সহায়ক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা যায়, তবে তারা ভবিষ্যতে আরও সচেতন, যুক্তিনিষ্ঠ এবং আত্মবিশ্বাসী নাগরিক হিসেবে সমাজে অবদান রাখতে পারবে। বিতর্ক এমন একটি ক্ষেত্র, যা শিক্ষার্থীদের কেবল একাডেমিক জ্ঞানেই সমৃদ্ধ করে না, বরং তাদের মনের দ্বার খুলে দেয়, চিন্তার স্বাধীনতা দেয়, প্রশ্ন করতে শেখায়।
প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা প্রায়শই মুখস্থ নির্ভরতা ও পরীক্ষাকেন্দ্রিক সাফল্যকেই গুরুত্ব দিই। এতে অনেক শিক্ষার্থী কেবল পাঠ্যবইয়ের তথ্য মুখস্থ করে ভালো ফলাফল করলেও বাস্তব জীবনে জ্ঞানের প্রয়োগ, বিশ্লেষণ বা যুক্তি দিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকে। বিতর্ক চর্চা এই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে সহায়ক। একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য শিক্ষার্থীকে নির্দিষ্ট বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে হয়, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবতে হয় এবং বিপরীত মতের যুক্তিও উপলব্ধি করতে হয়। এই প্রক্রিয়ায় তার চিন্তাভাবনার গভীরতা বাড়ে এবং বিশ্লেষণাত্মক ক্ষমতা বিকশিত হয়।
বিতর্ক চর্চার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো যুক্তিনির্ভর বক্তব্য উপস্থাপন এবং যুক্তিপূর্ণ জবাব দেওয়ার চর্চা। বর্তমান সময়ে তথ্যের মহাবিস্ফোরণের যুগে আমরা প্রায়শই ভুল তথ্য, গুজব বা পক্ষপাতদুষ্ট মতামতের দ্বারা প্রভাবিত হই। বিতর্ক শেখায় কীভাবে সঠিক উৎস থেকে তথ্য যাচাই করতে হয়, কীভাবে নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করতে হয় এবং কীভাবে দায়িত্বশীল মত প্রকাশ করা যায়। এটি শিক্ষার্থীদের ‘মত’ নয়, বরং ‘যুক্তির’ মাধ্যমে কথা বলার অভ্যাস গড়ে তোলে। এছাড়া, বিতর্ক চর্চা ব্যক্তিগত দক্ষতাও উন্নত করে। বক্তৃতা দেওয়ার আত্মবিশ্বাস, শ্রোতাকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা, সময় ব্যবস্থাপনা, দলগত কাজের সমন্বয়—এসবই একজন বিতার্কিকের মাঝে স্বাভাবিকভাবে গড়ে ওঠে। একজন শিক্ষার্থী যখন বিতর্কের মাধ্যমে নিজের মতামত সুনির্দিষ্টভাবে উপস্থাপন করতে শেখে, তখন সে যেকোনো পরিস্থিতিতে সাহসের সঙ্গে নিজের বক্তব্য প্রকাশ করতে পারে। এটি তার ব্যক্তিত্বে দৃঢ়তা এবং নেতৃত্বগুণ এনে দেয়।
সামাজিক-মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও বিতর্ক চর্চা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিতর্কের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ভিন্নমত গ্রহণ করার মনোভাব গড়ে তোলে, যা গণতান্ত্রিক মানসিকতার ভিত্তি। তারা শিখে কীভাবে মতভেদ থাকা সত্ত্বেও শালীনভাবে আলোচনায় অংশ নিতে হয়, কীভাবে প্রতিপক্ষের বক্তব্যকে সম্মান জানিয়ে যুক্তিপূর্ণ প্রতিবাদ জানাতে হয়। এই সহনশীলতা, শ্রদ্ধাশীলতা ও যুক্তির ভিত্তিতে মত প্রকাশ—সবই একজন সুসভ্য ও সচেতন নাগরিক গঠনের পূর্বশর্ত।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগেই বিতর্ক চর্চাকে এখনো প্রান্তিক পর্যায়ে রাখা হয়েছে। বিতর্ক ক্লাব গঠন, প্রশিক্ষণ, নিয়মিত অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা কিংবা অভিভাবকদের উৎসাহ—এসবের অভাবে অনেক শিক্ষার্থী কখনোই বিতর্কে অংশ নেওয়ার সুযোগ পায় না। অথচ এটি একটি সহজলভ্য এবং অতি কার্যকর সহ-শিক্ষা কার্যক্রম। বিশেষত গ্রামাঞ্চলের স্কুল ও কলেজগুলোতে বিতর্ক চর্চার সুযোগ সীমিত হওয়ায় সেই অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা আত্মপ্রকাশের ও মননচর্চার গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
সৌভাগ্যবশত, বর্তমানে কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং শিক্ষাবোর্ড বিতর্ক চর্চার প্রসারে কাজ করছে। বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, কর্মশালা, ক্যাম্প এবং প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতর্কের প্রতি আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এটি এখনো একক প্রচেষ্টা পর্যায়ে রয়েছে। প্রয়োজন হলো জাতীয় পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা, যেখানে প্রতিটি স্কুল ও কলেজে বিতর্ক ক্লাব গঠন বাধ্যতামূলক হবে এবং বিতর্ক শিক্ষক বা মেন্টর নিয়োগ দেওয়া হবে।
শিক্ষকদের ভূমিকাও এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন উৎসাহী শিক্ষকই পারেন শিক্ষার্থীদের বিতর্কে আগ্রহী করে তুলতে। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সমসাময়িক ইস্যু নিয়ে ভাবতে শেখানো, তাদের উৎসাহ দেওয়া, দল গঠন করে প্রশিক্ষণ দেওয়া—এসব উদ্যোগ শিক্ষকদের পক্ষ থেকে আসতে হবে। একইসঙ্গে অভিভাবকদেরও বুঝতে হবে, বিতর্ক কেবল পড়াশোনার বাইরে সময় নষ্ট নয়; বরং এটি সন্তানদের একটি পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়ক।
আজকের শিক্ষার্থীরাই আগামীর রাষ্ট্রনায়ক, চিন্তাবিদ, বিজ্ঞানী ও সমাজ সংস্কারক। তাদের যদি আমরা যুক্তিবাদী, বিশ্লেষণক্ষম এবং আত্মপ্রকাশে দক্ষ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, তবে বিতর্ক চর্চাকে আমাদের শিক্ষার অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। বিতর্ক চর্চা যেন শহরকেন্দ্রিক কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে, বরং তা যেন দেশের প্রতিটি শিক্ষার্থী, প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে পৌঁছে যায়—এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
আমরা যদি চাই একটি যুক্তিনির্ভর, সহনশীল ও সচেতন প্রজন্ম গড়ে তুলতে, তাহলে এখনই সময় বিতর্ক চর্চাকে নতুন গুরুত্ব ও গতিতে এগিয়ে নেওয়ার। শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বরকে যুক্তির ভাষা দিন—তারা গড়ে তুলবে একটি আলোকিত সমাজ।
(শিক্ষক ও প্রাক্তন বিতর্কিক)