Close

পদ্মার ঢেউয়ে ভেসে যাওয়া জীবন

নদী ভাঙ্গন

নদী ভাঙ্গন

১. নদীর গর্ভে গ্রাম

পদ্মা নদীর তীরে ছোট্ট গ্রাম ছিল সাতভৈরব। ছায়াঘেরা পথ, মাঠের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছ, আর নদীর গর্জনে ডুবে থাকা প্রতিটি সন্ধ্যা — যেন প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। সেই গ্রামেই জন্ম হয়েছিল হালিমা খাতুনের। বিয়ের পর স্বামী ফরিদ মাঝির সঙ্গে সে ছিল সুখেই।

কিন্তু বিগত দশকে গ্রামের ছবিটা বদলে যেতে শুরু করে। পদ্মা নদী যেন ক্রমশ খিদে পেতে লাগল — একটু একটু করে গিলে ফেলল মানুষের ঘর, ফসলি জমি, কবরস্থান, এমনকি স্কুলবাড়িও। একসময় যে জায়গায় তারা ঈদগাহে নামাজ পড়ত, এখন সেখানে কেবল ঢেউয়ের ধাক্কা আর পলির স্তূপ।

হালিমার ঘরটা ছিল একেবারে নদীর ধারেই — তিন পুরুষ ধরে সেই জমি ছিল তাদের। সেখানে দাঁড়িয়ে সে বলত, “নদী তো আমাদের মা।” কিন্তু এক রাতে সেই মা-ই তার ঘরটাকে টেনে নিল বুকের গভীরে।

সেই রাতে, তীব্র বৃষ্টির মধ্যে, দরজা খুলে ফরিদ ছুটে গেল পাড়ার লোক ডাকতে। কিন্তু কিছুই রক্ষা করা গেল না। খুঁটির সঙ্গে বাঁধা গরুটি, মাটির চুলা, এমনকি শিশুপুত্র মোরশেদের বইপত্র — সবকিছু চলে গেল জলের গর্ভে।

২. গ্রাম ছাড়ার সিদ্ধান্ত

পরদিন সকালে, কাদা-পানিতে ভেজা কাপড় পরে বসে ছিল হালিমা। ছেলে-মেয়েরা চুপ করে মায়ের পাশে। ফরিদ কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আর না। এই নদীর সাথে যুদ্ধ করে পারব না। চলো, শহরে যাই।”

কথাটা সহজ ছিল না। এই গ্রামই তো ছিল তাদের চেনা পৃথিবী — শিকড়, ইতিহাস, আত্মপরিচয়। কিন্তু আর কোনো উপায় ছিল না। পাড়ার আরও কয়েকটা পরিবারও একই চিন্তা করছিল।

বস্তাবন্দী কিছু কাপড়, চালের হাঁড়ি, আর ভাঙা রেডিও — এই ছিল হালিমার সম্বল। একটি ট্রলারে করে তারা রওনা দিল ঢাকার দিকে। চোখের জল আর অজানা ভবিষ্যতের ভয় নিয়ে পিছন ফিরে চেয়ে থাকল সাতভৈরবের শেষ অংশটুকুর দিকে — যেখানে একদিন ঘর ছিল, আর এখন কেবল পানি।

৩. নতুন শহর, অচেনা যুদ্ধ

ঢাকায় পৌঁছে তারা আশ্রয় পেল কড়াইল বস্তিতে, গুলশানের পাশে এক বিপরীত জগত। উঁচু দালানের পেছনে ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে থাকা টিনের ঘর, নর্দমার গন্ধ, ও রোদে পুড়ে যাওয়া মুখগুলো — এক ভিন্ন বাস্তব।

প্রথম ক’দিন হালিমার চোখে ঘুম ছিল না। শহরের শব্দ, পানের দোকানে মারামারি, আর পানির জন্য ভোরে লাইন ধরতে গিয়ে ধাক্কাধাক্কি — সবকিছু তাকে ক্লান্ত করে তুলছিল।

ফরিদ কাজ পায়নি। নদী বাদ দিয়ে সে আর কিছুই জানে না। হালিমা গার্মেন্টসে কাজ শুরু করল — ১২ ঘণ্টা সেলাই মেশিনে বসে, খাটুনি আর গালাগালির মধ্যে পারিশ্রমিক মাত্র ৪,৫০০ টাকা।

বাচ্চারা স্কুলে যেতে চায়, কিন্তু ইউনিফর্ম, খাতা-পেন কেনার সামর্থ্য নেই। তবু হালিমা মোরশেদকে বলে, “তুই একদিন মাস্টার হবি। নদী যদি ঘর নিতে পারে, তোর পড়া কেড়ে নিতে পারবে না।”

৪. স্মৃতির ছায়া

হালিমা রাতে ঘুমোতে গেলে প্রায়ই চোখে দেখতে পায় পুরনো সেই ঘর — মাটির দেওয়াল, দাওয়ায় বসা শ্বশুর, আর পিঠার গন্ধ। চোখ খোলামাত্র তাকে ফিরতে হয় কঠোর বাস্তবে।

এক সন্ধ্যায়, বৃষ্টির মধ্যে মোরশেদ হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, “মা, আমরা আবার কি ওই গ্রামে ফিরতে পারব?”

হালিমা জবাব দিতে পারে না। শুধু জানে, যেদিন নদী তার ঘরটা নিয়ে গেল, সেদিন তার ভেতরের মাটিও সরে গিয়েছিল। সে আর কোনো দিন আগের মতো ‘ঘরের মেয়ে’ নয়, বরং এক ঘরহারা মা।

৫. প্রতিবাদ আর প্রত্যয়

বস্তিতে হালিমা যে একা নয়, তা বুঝতে বেশিদিন লাগেনি। তার পাশের ঘরে রাশিদার পরিবার এসেছে বরিশাল থেকে, দোয়েল এসেছে সন্দ্বীপ থেকে — সব জায়গার গল্পে এক সুর, “জল এসে সব নিল।”

একদিন স্থানীয় একটি এনজিও এসে বস্তির লোকদের নিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কথা বলে। হালিমা সেখানে সাহস করে নিজের গল্প বলে — কেমন করে নদী তার ঘর নিয়ে গেছে, কীভাবে শহরে এসে তাদের বাঁচার সংগ্রাম।

বক্তব্যটা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। এক সাংবাদিক তার গল্প তুলে ধরে সংবাদপত্রে — “জলবায়ু উদ্বাস্তু: হালিমা খাতুনের কষ্টের কাহিনি”।

প্রথমবার হালিমা অনুভব করে, তার জীবনটা কেবল কষ্ট নয় — এটা এক প্রতিবাদ, এক ইতিহাস।

৬. নতুন পরিচয়

এনজিও-র সহায়তায় হালিমা একটি ছোট কোচিং সেন্টার খোলে বস্তিতে। সে গার্মেন্টসের কাজ ছেড়ে এখন ২০টা শিশুকে পড়ায় — পড়া তো নয় শুধু, শেখায় বাঁচার পাঠ।

মোরশেদ এখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে, আর বলেছে সে “পরিবেশবিদ” হবে। সে জানতে চায়, কীভাবে গ্লোবাল ওয়ার্মিং কাজ করে, আর কেন তাদের গ্রামটা হারিয়ে গেল।

হালিমা মুচকি হেসে বলে, “তুই যদি একদিন দেশের মন্ত্রী হস, তবে নদীর পাড়ে নতুন ঘর বানাবি আমাদের মতো মানুষের জন্য।”

মোরশেদ হেসে মাথা নাড়ে।

৭. শেষ নয়, শুরু

বছর তিনেক পর, একদিন এক বৃষ্টিভেজা সকালে হালিমা ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকায়। চারপাশে গর্জন করছে মেঘ, কিন্তু তার মুখে হাসি।

হয়তো নদী তার শেকড় কেটে দিয়েছে, কিন্তু সে আবার দাঁড়িয়েছে। জল তার ঘর নিতে পারে, কিন্তু ইচ্ছা, সাহস আর ভালোবাসা কেড়ে নিতে পারে না।

হালিমা এখন কেবল একজন মা নয়, একজন যোদ্ধা — এক “জলবায়ু উদ্বাস্তু”, যিনি নিজের ছেলেমেয়েদের জন্য নতুন ভবিষ্যৎ তৈরি করছেন।

এই গল্প হালিমা নামের এক নারীর, কিন্তু এর পেছনে হাজারো বাস্তব মুখ লুকিয়ে আছে। প্রতিদিন পৃথিবীর নানা প্রান্তে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘরছাড়া হচ্ছেন। তারা কেবল পরিসংখ্যান নয়, তারা ইতিহাস, যন্ত্রণার ছায়া, আর নতুন আশার নাম।

আর্টিস্ট এবং লেখক

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Leave a comment
scroll to top