Close

লিপস্টিক: নারীর সৌন্দর্যের অনন্য অনুষঙ্গ

লিপস্টিক: নারীর সৌন্দর্যের অনন্য অনুষঙ্গ

লিপস্টিক: নারীর সৌন্দর্যের অনন্য অনুষঙ্গ

লিপস্টিক—এই ছোট্ট কিন্তু প্রভাববিস্তারী প্রসাধনীটি যুগ যুগ ধরে নারীর সৌন্দর্যবর্ধনের একটি অপরিহার্য উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এটি শুধু একটি রঙিন প্রসাধনী নয়; এটি নারীর আত্মবিশ্বাস, রুচি, এবং কখনও কখনও তার ব্যক্তিত্বের প্রকাশক। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে লিপস্টিক শুধুমাত্র সাজগোজের অংশ নয়, বরং এটি একটি ফ্যাশন স্টেটমেন্ট, এক্সপ্রেশন অব মুড, এমনকি নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীকও হয়ে উঠেছে।

কিন্তু এই জনপ্রিয় প্রসাধনী কীভাবে তৈরি হয়েছিল?

এর জন্য আমাদের প্রাগৈতিহাসিক যুগের দিকে ফিরে তাকাতে হবে। লিপস্টিক প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিল ৫,০০০ বছর আগে। সেই সময় থেকে সৌন্দর্যচর্চা চলে আসছে। কিন্তু লিপস্টিক সম্পর্কে কোনও শক্তিশালী প্রমাণ ছিল না। তবে, সেই সময়ে সৌন্দর্যচর্চায় ফল, ফুল এবং গাছের রস দিয়ে তৈরি ঘরে তৈরি রঞ্জক ব্যবহার করা হত।

তখন মেসোপটেমিয়ার অভিজাতরা তাদের ঠোঁটে রত্নপাথর ব্যবহার করত। তারা রত্ন পিষে ঠোঁটে লাগাতেন, যার মাধ্যমে ঠোঁট পেত লালচে বা গোলাপি আভা। প্রাচীন মিশরের ফারাও রানী ক্লিওপেট্রা নিজেও পোকামাকড় এবং প্রাকৃতিক রঞ্জক ব্যবহার করে লিপ রঙ তৈরি করতেন। তবে, লিপস্টিকের নাম তখনও প্রচলিত ছিল না। মিশরীয়রা লাল রঙ তৈরিতে অ্যালজিনেট, আয়োডিন এবং ব্রোমিনের মিশ্রণ ব্যবহার করত।

ইউরোপে রেনেসাঁ যুগে লিপস্টিক আবার ফিরে আসে ফ্যাশনের অনুষঙ্গ হিসেবে। বিশেষত ইংল্যান্ডের রাণী এলিজাবেথ প্রথম, যিনি মুখে সাদা রঙ এবং ঠোঁটে উজ্জ্বল লাল লিপস্টিক ব্যবহার করে এক অনন্য স্টাইল আইকনে পরিণত হন। তবে সে সময় লিপস্টিককে মাঝে মাঝে ‘অপমানজনক’ বা ‘জাদুকরী’ কাজের অংশ হিসেবে গণ্য করা হতো।

লিপস্টিক শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৮৮০ সালে। ১৮৮৪ সালে প্যারিসের একটি সুগন্ধি কোম্পানি প্রথম বাণিজ্যিক লিপস্টিক তৈরি করে। তবে, আজকের মতো চকচকে মোড়ক বা টিউবের ব্যবহার ছিল না। 

উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে এসে আধুনিক লিপস্টিকের উৎপাদন শুরু হয়। ১৯২০ সালে রেভলন এবং ম্যাক্স ফ্যাকটরের মতো কোম্পানিগুলি বাণিজ্যিকভাবে লিপস্টিক বাজারজাত করতে থাকে। ধীরে ধীরে এটি সবার জন্য সহজলভ্য ও দৈনন্দিন প্রসাধনীর অংশে পরিণত হয়।

১৯৯৫ সালে, লিপস্টিক বাজারজাত করার জন্য প্রথম ধাতব টিউব ব্যবহার করা হয়েছিল। ১৯৩০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম টিউবটি চালু হয়েছিল। এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, এটি একটি প্রসাধনী পণ্য হিসেবে মহিলাদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

লিপস্টিক তৈরির একক কৃতিত্ব কাউকে দেওয়া যাবে না। তবে, অনেক ঐতিহাসিক স্বীকার করেন যে প্রাচীন আরব প্রসাধনী বিশেষজ্ঞ আল জাহরাউই প্রথম মোটা লিপস্টিক তৈরি করেছিলেন।

লিপস্টিকের রঙ এবং মানসিকতা

মানুষের আবেগ, ব্যক্তিত্ব এবং এমনকি সামাজিক অবস্থানও লিপস্টিকের রঙের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। যেমন:

  • লাল : আত্মবিশ্বাস, শক্তি এবং যৌন আকর্ষণের প্রতীক।
  • গোলাপি: কোমলতা, রোমান্টিকতা এবং নারীত্ব।
  • নিউড: ন্যাচারাল লুক, পরিপক্কতা এবং প্রফেশনালিজম।
  • গাঢ় বেগুনি বা কালো: সাহসী, বিদ্রোহী এবং স্টাইলিশ মনোভাব।

অনেক সময় একজন নারী কোন পরিস্থিতিতে আছেন, তার উপরও নির্ভর করে সে কী রঙের লিপস্টিক বেছে নিচ্ছেন।

লিপস্টিক এবং নারীর ক্ষমতায়ন

লিপস্টিক কেবল একটি সৌন্দর্য পণ্য নয়; এটি নারীর স্বাধীনতা এবং আত্মপরিচয়ের প্রতীক। একটি সময় ছিল যখন এটা ব্যবহারকে অসামাজিক বলা হতো, আজ সেই লিপস্টিকই নারীর আত্মবিশ্বাসের অন্যতম হাতিয়ার। অফিস, মিটিং, ইন্টারভিউ, উৎসব কিংবা একটি নরমাল দিনেও লিপস্টিক একজন নারীকে করে তোলে আরও আত্মপ্রত্যয়ী।

বিশ্বব্যাপী অনেক নারী আন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠেছে লাল লিপস্টিক—যেমন ‘রেড লিপস্টিক মোভমেন্ট’, যেখানে নারীরা তাদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরতে লাল লিপস্টিক পরে প্রতিবাদ জানায়।

এটা শুধু একটি প্রসাধনী নয়; এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি, সৌন্দর্য এবং আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। একজন নারীর সাজের পূর্ণতা এনে দিতে এটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি তার ভেতরের শক্তিকে জাগিয়ে তুলতেও এটি এক অসাধারণ মাধ্যম। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে লিপস্টিকও হয়ে উঠেছে আরও ইনক্লুসিভ, আরও পরিবেশবান্ধব ও বৈচিত্র্যময়। তাই এটা নিয়ে আলোচনা মানেই নারীর অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক সৌন্দর্য ও শক্তির উদযাপন।

আর্টিস্ট এবং লেখক

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Leave a comment
scroll to top