Close

কোলিন: আমাদের মস্তিষ্কের জন্য অত্যাবশ্যক কিন্তু অবমূল্যায়িত একটি পুষ্টি উপাদান

কোলিন: আমাদের মস্তিষ্কের জন্য অত্যাবশ্যক কিন্তু অবমূল্যায়িত একটি পুষ্টি উপাদান

কোলিন: আমাদের মস্তিষ্কের জন্য অত্যাবশ্যক কিন্তু অবমূল্যায়িত একটি পুষ্টি উপাদান

এই যৌগটি স্মৃতিশক্তি ও মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে এবং উদ্বেগ কমাতে কার্যকর — কিন্তু আপনি কি যথেষ্ট কোলিন গ্রহণ করছেন?

আপনি হয়তো আগে কোলিন সম্পর্কে খুব একটা শোনেননি, তবে গবেষণা বলছে, জীবনের নানা পর্যায়ে এটি আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি কোনও ভিটামিন বা খনিজ নয়, বরং একটি জৈব যৌগ, যা স্নায়ুতন্ত্রকে সঠিকভাবে কাজ করতে সাহায্য করে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, কোলিনের উচ্চ মাত্রার গ্রহণ শুধু জ্ঞানীয় দক্ষতা বাড়াতে পারে না, ADHD বা ডিসলেক্সিয়ার মতো স্নায়ুবিক সমস্যা প্রতিরোধেও ভূমিকা রাখতে পারে।

এই পুষ্টি উপাদানটি স্নায়ু বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ বলে ধারণা করা হয়। যেমন, এক গবেষণায় দেখা গেছে—যেসব মা গর্ভাবস্থায় কোলিন সাপ্লিমেন্ট নিয়েছেন, তাদের শিশুদের তথ্য প্রক্রিয়াকরণের গতি বেশি ছিল, যা ভালো মানসিক সক্ষমতার একটি সূচক।

বিজ্ঞানীরা মনে করেন, কোলিন একটি উপেক্ষিত অথচ অত্যন্ত কার্যকর পুষ্টি উপাদান। এখন প্রশ্ন হলো—এই কোলিন আসে কোথা থেকে এবং আমরা কি তা যথেষ্ট পাচ্ছি?

নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিন কলেজের পুষ্টি বিজ্ঞানী জিনইন জিয়াং জানিয়েছেন, আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষে কোলিন থাকে। এটি একটি “প্রয়োজনীয়” পুষ্টি উপাদান—অর্থাৎ, শরীর এটি নিজে থেকে সামান্য পরিমাণে তৈরি করলেও, পর্যাপ্ত মাত্রায় পেতে হলে আমাদের খাদ্য থেকে তা গ্রহণ করতে হয়। এটি কিছুটা ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের মতো হলেও, গঠন ও কার্যকারিতায় বি ভিটামিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

কোলিন প্রধানত প্রাণিজ উৎসে পাওয়া যায়—যেমন ডিম, গরুর মাংস, মাছ, মুরগি এবং দুধ। তবে উদ্ভিজ্জ উৎসেও যেমন চিনাবাদাম, কিডনি বিন, মাশরুম এবং ব্রোকলিতে কিছুটা কোলিন থাকে, যদিও পরিমাণে কম।

আমাদের দেহের নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজ—বিশেষ করে লিভারের সঠিক কার্যকারিতা—চালিয়ে যেতে কোলিন অপরিহার্য। যদি তা পর্যাপ্ত না হয়, তবে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।

জিয়াং ব্যাখ্যা করেন, কোলিন লিভার থেকে চর্বি অপসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, এবং এর অভাবে ফ্যাটি লিভারের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এটি শরীরে ফসফোলিপিড নামক এক প্রকার যৌগ তৈরিতেও সহায়তা করে, যা কোষের পর্দার গঠন উপাদান। কোলিনের অভাব কোষ বিভাজনের সঙ্গে যুক্ত জিনগুলোর কার্যক্রমকে ব্যাহত করতে পারে, বিশেষ করে ভ্রূণ অবস্থায়, যখন মস্তিষ্কে কোষের বৃদ্ধির জন্য এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

মস্তিষ্কে কোলিনের ভূমিকা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, ডার্বিশায়ার একে “মস্তিষ্কের পুষ্টি” হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। আমাদের নিউরোট্রান্সমিটার অ্যাসিটাইলকোলিন তৈরি করতে কোলিন দরকার হয় — এই রাসায়নিকটি স্নায়ু কোষের মাধ্যমে মস্তিষ্ক থেকে দেহের বিভিন্ন অংশে বার্তা প্রেরণ করে। এটি আমাদের চিন্তা, স্মৃতি এবং শেখার প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৩৬ থেকে ৮৩ বছর বয়সী প্রায় ১,৪০০ জনের মধ্যে যারা বেশি কোলিন গ্রহণ করেন, তাদের স্মৃতিশক্তি তুলনামূলকভাবে ভালো। এতে ইঙ্গিত মিলেছে যে, মধ্যবয়সে কোলিন গ্রহণ মস্তিষ্কের সুরক্ষায় সহায়ক হতে পারে। কোলিন প্রায়ই স্মৃতি ও শেখার দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত নুট্রোপিক সম্পূরকগুলোর একটি উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

কিন্তু কোলিনের ঘাটতি গুরুতর হতে পারে — এটি আলঝেইমার ও পার্কিনসনের মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত।

কোলিন আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকেও প্রভাবিত করতে পারে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা বেশি কোলিন গ্রহণ করেন, তাদের উদ্বেগের মাত্রা তুলনামূলকভাবে কম। অন্য এক গবেষণায় কোলিনের উচ্চ খাদ্যতালিকাগত গ্রহণ বিষণ্নতার ঝুঁকি হ্রাসের সাথে সম্পর্কিত ছিল।

কোলিনের পর্যাপ্ত গ্রহণ আরও অনেক উপকারে আসতে পারে। যেমন, ইঁদুরের উপর করা গবেষণায় দেখা গেছে, এটি হোমোসিস্টিন নামক একটি অ্যামিনো অ্যাসিডের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। হোমোসিস্টিনের উচ্চ মাত্রা অস্টিওপোরোসিসের সাথেও যুক্ত, এবং দেখা গেছে, যারা বেশি কোলিন গ্রহণ করেন, তাদের হাড়ের ঘনত্ব বেশি থাকে — যা হাড় মজবুত রাখার একটি ভালো সূচক।

নরওয়ের ইনস্টিটিউট অফ মেরিন রিসার্চের গবেষক ওয়েন জ্যানিক বলেন, কোলিন হাড় ক্ষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। এর পেছনে কারণ হতে পারে হোমোসিস্টিনের মাত্রা হ্রাস, তবে কোলিন কোষের পর্দার গঠনেও এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

শিশুর জীবনের প্রথম ১০০০ দিন
বাচ্চার জীবনের শুরু থেকে দুই বছর পর্যন্ত সময়টা তার বিকাশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে, গর্ভাবস্থা ও স্তন্যপানের সময় মায়ের খাদ্য ভূমিকা রাখে শিশুর স্বাস্থ্য নির্ধারণে। গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভে শিশুর বিকাশে কোলিন অত্যন্ত জরুরি। শিশুরা সাধারণত মায়ের তুলনায় তিনগুণ বেশি কোলিনসহ জন্মায় — যা বোঝায় এই সময়ে কোলিন কতটা অপরিহার্য।

একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভাবস্থায় কোলিনের পর্যাপ্ত সরবরাহ শিশুর ভবিষ্যৎ মানসিক বিকাশের সঙ্গে যুক্ত এবং এর ইতিবাচক প্রভাব বহু বছর ধরে বজায় থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে সবচেয়ে বেশি কোলিন গ্রহণ করেছেন, তাদের শিশুরা সাত বছর বয়সে স্মৃতিশক্তি পরীক্ষায় ভালো ফল করেছে।

কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভাবস্থায় যদি একজন মা পর্যাপ্ত কোলিন না পান, তবে তা ভবিষ্যতে সন্তানের ADHD-এর মতো আচরণগত সমস্যার ঝুঁকি বাড়াতে পারে। ডার্বিশায়ার বলেন, “আমরা স্কুলে ADHD এবং ডিসলেক্সিয়ার হার বাড়তে দেখছি। যদিও কিছুটা জেনেটিক কারণ রয়েছে, কিন্তু গর্ভকালীন সময়ে অপর্যাপ্ত পুষ্টিও এই সমস্যাগুলোর পেছনে থাকতে পারে। ওই সময়ে স্নায়বিক বিকাশে সূক্ষ্ম পরিবর্তন ঘটে, যা পরে প্রভাব ফেলে — এবং আমরা তখন চিকিৎসা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা করি।”

জিয়াং গর্ভাবস্থা ও স্তন্যপান চলাকালীন কোলিন গ্রহণ এবং শিশুদের মস্তিষ্ক বিকাশের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি বলেন, “প্রাণীদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যখন মায়েদের খাদ্যে বেশি কোলিন থাকে, তখন তাদের বাচ্চাদের মানসিক বিকাশ ভালো হয়। এখন মানুষের ক্ষেত্রেও মিলতাজনক ফল পাওয়া যাচ্ছে, যদিও তা পুরোপুরি এক নয়।”

মস্তিষ্কের পুষ্টি

২০২০ সালে ৩৮টি প্রাণী ও ১৬টি মানব গবেষণার উপর ভিত্তি করে এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কোলিন সাপ্লিমেন্ট মস্তিষ্কের বিকাশে সহায়ক হতে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত মূলত প্রাণী গবেষণাই কোলিন ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতির মধ্যে শক্তিশালী সম্পর্ক দেখিয়েছে। অধিকাংশ মানব গবেষণায় প্রতিদিন প্রায় ৯৩০ মিলিগ্রাম কোলিন সরবরাহ করা হয়েছিল — যা প্রায় ছয়টি ডিমের সমান — এবং এতে কোনো ক্ষতিকর প্রভাব দেখা যায়নি।

ওয়েন মনে করেন, কিছু মানুষের কোলিনের চাহিদা গড় মানের চেয়ে বেশি হতে পারে, বিশেষ করে মেনোপজ-পরবর্তী নারীরা ও যারা ফ্যাটি লিভার সমস্যায় ভুগছেন। ডার্বিশায়ার জানান, জেনেটিক ভিন্নতার কারণে কিছু মানুষের কোলিনের প্রয়োজন অন্যদের তুলনায় বেশি হতে পারে।

জিয়াং বলেন, “খাবারের মাধ্যমে কোলিন খুব সহজে রক্তে শোষিত হয়,” যা যথাযথ গ্রহণ নিশ্চিত করতে সাহায্য করে।

তবে গবেষণা বলছে, আমাদের অনেকেই পর্যাপ্ত কোলিন পাচ্ছি না। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ১১% আমেরিকান প্রাপ্তবয়স্ক প্রতিদিনের প্রস্তাবিত পরিমাণ কোলিন গ্রহণ করেন।

ডিম হলো কোলিনের অন্যতম শক্তিশালী উৎস। ফলে, যারা নিরামিষ খাদ্য অনুসরণ করেন, তাদের জন্য পর্যাপ্ত কোলিন পাওয়া একটু কঠিন হতে পারে। যদিও অনেক উদ্ভিদ-ভিত্তিক উৎস এবং সহজলভ্য পরিপূরক থাকায় এই ঘাটতি কিছুটা পূরণ করা সম্ভব।

গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত ডিম খান, তারা অন্যদের তুলনায় দ্বিগুণ কোলিন পান। এই তথ্য থেকে বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ডিম বা কোলিন সাপ্লিমেন্ট ছাড়া কেবল খাদ্য থেকে পর্যাপ্ত কোলিন গ্রহণ করা “অত্যন্ত কঠিন”।

তবে ইউরোপীয় খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ (EFSA) প্রতিদিন ৪০০ মিলিগ্রাম কোলিন গ্রহণের পরামর্শ দেয়, যা জিয়াং বলেন বেশিরভাগ মানুষের পক্ষেই সম্ভব — যদি খাদ্য পরিকল্পনা সচেতনভাবে করা হয়। টফু (১০০ গ্রামে ২৮ মিলিগ্রাম), চিনাবাদাম মাখন (৬১-৬৬ মিলিগ্রাম), ও সয়াবিন (১২০ মিলিগ্রাম) কিছু নিরামিষ উৎস হিসেবে কোলিন সরবরাহ করতে পারে।

যারা সন্দেহ করছেন তারা পর্যাপ্ত কোলিন পাচ্ছেন না, তারা প্রতিদিন একটি কোলিন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে পারেন বলে ওয়েন পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে তিনি বলেন, কোলিনের স্বাস্থ্য উপকারিতা আরও ভালোভাবে বুঝতে আরও গবেষণা দরকার।

তবে ডার্বিশায়ার আশাবাদী — “চিকিৎসকরা এখন কোলিন নিয়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন হচ্ছেন।” যদিও এতদিন এটি কিছুটা উপেক্ষিত ছিল, তিনি মনে করেন, কোলিন খুব শিগগিরই তার যথাযথ গুরুত্ব পেতে শুরু করবে।

আর্টিস্ট এবং লেখক

2 Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

2 Comments
scroll to top