খাবার আমাদের মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। মেজাজ, বুদ্ধিবৃত্তীয় কার্যকারিতা এমনকি মস্তিষ্ক-সম্পর্কিত রোগের ঝুঁকির উপরও প্রভাব ফেলে।
সুষম খাদ্য রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল রেখে মন-মেজাজ উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ এবং বিরক্তির মতো লক্ষণগুলি হ্রাস করতে পারে। একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্য নিউরোপ্লাস্টিসিটি, মস্তিষ্কের অভিযোজন এবং পরিবর্তনের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে এবং নতুন মস্তিষ্কের কোষ গঠনে সহায়তা করতে পারে।
মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য উন্নত করার জন্য বেশ কিছু খাবার পরিচিত, যার মধ্যে রয়েছে তৈলাক্ত মাছ, সবুজ শাকসবজি, বেরি, বাদাম, বীজ জাতীয় খাবার এবং অ্যাভোকাডো। এই খাবারগুলিতে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান রয়েছে যা বুদ্ধিবৃত্তীয় কার্যকারিতা এবং স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে।
এখানে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বৃদ্ধিকারী কিছু শীর্ষ খাবারের আরও বিশদ বিবরণ দেওয়া হল:
১. তৈলাক্ত মাছ:
বড় রুই, কাতলা, চীতল, পাঙ্গাস, ইলিশ, স্যামন, টুনা, ম্যাকেরেল এবং অন্যান্য তৈলাক্ত মাছ ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের (DHA এবং EPA) চমৎকার উৎস। মস্তিষ্কের গঠন এবং কার্যকারিতার জন্য ওমেগা-৩ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং উন্নত স্মৃতিশক্তি, মনোযোগ এবং বুদ্ধিবৃত্তীয় কর্মক্ষমতা তৈরিতে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও মাছে উপস্থিত উন্নতমানের আমিষ মস্তিষ্কের গঠনেও বিশেষ ভুমিকা পালন করে।
২. পাতাযুক্ত সবুজ শাকসবজি:
কলমিশাক, পালং শাক, কলার্ড শাক, এসপারাগাস, লেটুস, ধনেপাতা, পার্সলে এবং অন্যান্য পাতাযুক্ত শাকসবজি ভিটামিন, খনিজ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর, যার মধ্যে রয়েছে ভিটামিন কে এবং লিউটেইন। এই পুষ্টি উপাদানগুলি মস্তিষ্কের কোষগুলিকে ফ্রি-র্যাডিক্যাল দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতি থেকে রক্ষা করে, যা সামগ্রিক মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য এবং দীর্ঘায়ুতে অবদান রেখে সুস্থ মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
৩. বেরিজাতীয় ফল:
জাম, আঙ্গুর, কলা, কিউই, ব্লুবেরি, স্ট্রবেরি এবং অন্যান্য বেরি অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে সমৃদ্ধ, যা মস্তিষ্ককে ফ্রি-র্যাডিক্যালের কারণে ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রদাহ কমাতে এবং বুদ্ধিবৃত্তীয় কর্মক্ষমতা উন্নত করে।
৪. বাদাম এবং বীজ:
আখরোট, বাদাম, চিয়া বীজ এবং কুমড়োর বীজ স্বাস্থ্যকর চর্বি, প্রোটিন এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের ভালো উৎস। এই পুষ্টি উপাদানগুলি মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যকে সংরক্ষণ করে এবং বুদ্ধিবৃত্তীয় বা ক্যাল্কুলেটিভ ক্ষমতার ক্ষয় থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।
৫. অ্যাভোকাডো:
অ্যাভোকাডোতে প্রচুর পরিমাণে স্বাস্থ্যকর মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে, যা মস্তিষ্কের সঞ্চালন উন্নত করে এবং বুদ্ধিবৃত্তীয় কার্যকারিতাকে সক্ষম রাখতে সহায়তা করে। এটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ভিটামিনও সরবরাহ করে যা মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যে অবদান রাখে।
৬. ডিম:
ডিম কোলিনের একটি ভালো উৎস, একটি মস্তিষ্ককে অ্যাসিটাইলকোলিন তৈরি করতে সাহায্য করে, যা স্মৃতিশক্তি এবং শেখার সামর্থ তৈরি ও বজায় রাখতে সহায়তাকারী একটি নিউরোট্রান্সমিটার হিসাবে কাজ করে।
৭. ডার্ক চকলেট:
ডার্ক চকলেটে প্রচুর পরিমাণে ফ্ল্যাভোনয়েড থাকে, যার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং প্রদাহ-বিরোধী বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই যৌগগুলি মস্তিষ্ককে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে এবং সুস্থ বুদ্ধিবৃত্তীয় কার্যকারিতা সংরক্ষন করতে সাহায্য করে।
৮. হলুদ:
হলুদে থাকে কারকিউমিন, যা একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য এবং বুদ্ধিবৃত্তীয় কার্যকারিতা উন্নত করতে সহায়তা করে ।এটি মস্তিষ্ককে প্রদাহ এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেস থেকে রক্ষা করতেও সাহায্য করে।
৯. গ্রিন-টি:
গ্রিন-টি তে থাকে এল-থায়ানিন, একটি অ্যামিনো অ্যাসিড যা মস্তিষ্কের সান্তকরণ এবং মনোযোগ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। এটি মস্তিষ্ককের বয়সজনিত বুদ্ধিবৃত্তীয় ও চিন্তাশক্তির ক্ষয় থেকে রক্ষা করতেও সাহায্য করে।
১০. আস্ত শস্য:
লাল চাল, লাল আটা, রাগী, জোয়ার, বাজরা, কুইনোয়া এবং ওটসের মতো আঁশযুক্ত শস্য গ্লুকোজের স্থির নিঃসরণ নিশিত করে, যা মস্তিষ্কের প্রাথমিক জ্বালানি উৎস।
খাদ্যতালিকায় এই খাবারগুলোর পর্যাপ্ত উপস্থিতি নিশ্চিত করে মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যকে সবল ও কর্মক্ষম রাখতে এবং আপনার বুদ্ধিবৃত্তীয় কার্যকারিতা ও স্মৃতিশক্তি উন্নত করতে পারেন।
অপরদিকে, প্রক্রিয়াজাত খাবার, চিনিযুক্ত পানীয় এবং অস্বাস্থ্যকর চর্বি সমৃদ্ধ খাবার আমাদের শরীরের পাশাপাশি মস্তিষ্কেও প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে এবং বুদ্ধিবৃত্তীয় ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
নেতিবাচক প্রভাব সমূহ আরও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হল:
১। প্রদাহ:
অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং স্যাচুরেটেড ফ্যাট বেশি থাকে এমন খাবার মস্তিষ্কে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে, যা বুদ্ধিবৃত্তীয় কার্যকারিতার ক্ষতি করে এবং আলঝাইমার এবং ডিমেনশিয়ার মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
২। বুদ্ধিবৃত্তীয় কার্যকারিতা হ্রাস:
পর্যাপ্ত পরিমানে প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাব বিশেষ করে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড, ডিএইচএ এর মত উপাদানের অভাব স্মৃতিশক্তি, নতুন কিছু শেখার ক্ষমতা এবং মনোযোগকে ব্যাহত করে।
৩। মেজাজের ব্যাধি বা মনোবৈরাগ্য:
অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের কারণে রক্তে শর্করার অনিয়ন্ত্রিত ওঠানামা মন-মেজাজের অস্বাভাবিক পরিবর্তন, উদ্বেগ এবং বিরক্তির কারণ ঘটাতে পারে।
৪। তৃপ্তি বা সন্তুষ্টির অনুভুতি তৈরিতে বৈরী প্রভাবঃ
উচ্চ চিনি এবং উচ্চ চর্বিযুক্ত খাবার মস্তিষ্কের তৃপ্তি বা সন্তুষ্টির অনুভুতি তৈরির ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে, ফলে অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবনতা বৃদ্ধি পায় এবং চিনি ও চর্বির প্রতি আসক্তির সৃষ্টি হয় ফলে ওজন বৃদ্ধি সহ অন্যান্য অনেক রোগের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়।
৫। স্নায়বিক ক্ষতি:
সামূদ্রিক খাবারগুলোতে পারদ সহ অন্যান্য ভারী ধাতব মৌলের উচ্চ উপস্থিতির কারণে এগুলো বেশি পরিমানে খেলে তা মস্তিষের নিউরনের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। প্রচুর পরিমাণে অ্যালকোহল গ্রহণ মস্তিষ্কের কোষ ধ্বংস করার পাশাপাশি নিউরোট্রান্সমিশনের পরিবর্তন করে, মস্তিষ্কের যোগাযোগ ব্যাবস্থার পরিবর্তন করে মস্তিষ্কের সাভাবিক কার্যক্ষমতায় বিঘ্ন ঘটিয়ে মস্তিষ্কের স্বল্পমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী উভয় ধরনের ক্ষতিসাধন করে।
পরিশেষে টেক-এওয়ে মেসেজ হিসাবে বলতে হয়, খাবার মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। একটি সুষম এবং পুষ্টিকর খাদ্য সর্বোত্তম মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করতে পারে এবং বুদ্ধিবৃত্তীয় ক্ষয়ের ঝুঁকি কমাতে পারে, অন্যদিকে অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস মেজাজ, বুদ্ধিবৃত্তীয় ক্ষমতা এবং সামগ্রিক মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই খাদ্য নির্বাচনে সতর্ক দৃষ্টি রাখা সকলের জন্য একান্ত আবশ্যকীয়।
সকলের জন্য সুস্থ্য দেহ ও মনের কামনা করে আজকের মত শেষ করছি।
-সানজিদা শারমীন
সিনিয়র ক্লিনিকাল ডায়েটিশয়ান, ল্যাবএইড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, উত্তরা
এক্স- ডায়েটিশিয়ান, ইউনাইটেড হাসপাতাল লিমিটেড।