আপনি কি বিকেলে বারবার হাই তুলছেন বা কাজ চালিয়ে যেতে তৃতীয় কিংবা চতুর্থ কাপ কফির প্রয়োজন হচ্ছে? তাহলে সাবধান—এই উপসর্গগুলো হতে পারে গুরুতর ঘুমের ঘাটতির লক্ষণ, যা আপনার শরীরের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াতে পারে। আমেরিকান একাডেমি অফ স্লিপ মেডিসিন (AASM)-এর সাম্প্রতিক একটি পজিশন পেপারে এমনটাই বলা হয়েছে।
“ঘুম স্বাস্থ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, যার প্রভাব অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত,” বলেন ড. এরিক ওলসন, AASM-এর সভাপতি এবং মিনেসোটার রোচেস্টার মায়ো ক্লিনিকের পালমোনোলজিস্ট ও ঘুম বিশেষজ্ঞ।
তিনি বলেন, “গাড়ি চালানোর সময় ঘুমিয়ে পড়া থেকে শুরু করে অফিসে ভুল করা এবং দীর্ঘমেয়াদে গুরুতর শারীরিক জটিলতা—সবকিছুই অতিরিক্ত দিনের ঘুমের পরিণতি। এটা ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।” উল্লেখ্য, আমেরিকান একাডেমি অফ নিউরোলজি, ন্যাশনাল সেফটি কাউন্সিল ও আমেরিকান একাডেমি অফ ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানসসহ ২৫টি চিকিৎসা সংগঠন এই পেপারকে সমর্থন দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়মিত অন্তত সাত থেকে আট ঘণ্টার গুণগতমানসম্পন্ন ঘুম না পেলে ডায়াবেটিস, বিষণ্নতা, হৃদরোগ, কিডনি জটিলতা, উচ্চ রক্তচাপ, অতিরিক্ত ওজন এবং স্ট্রোকের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে বা খারাপ হতে পারে।
“আমেরিকানদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ দিনের বেলায় অতিরিক্ত ঘুমের অভিযোগ করেন। তাই এর পেছনের কারণ চিহ্নিত করে যথাযথ চিকিৎসা ও হস্তক্ষেপের গুরুত্বকে উপেক্ষা করা উচিত নয়,” বলেন ওলসন।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেন, মানুষ অনেক সময় দিনের ঘুমকে গুরুত্ব না দিয়ে হালকাভাবে দেখে, যেমন—অফিস মিটিংয়ে ঘুমিয়ে পড়া। কিন্তু এগুলো হতে পারে গুরুতর ঘুমের ঘাটির লক্ষণ।
“একঘেয়ে কোনো সভায় চোখ ঢলে পড়া মানেই যে আপনার ঘুমের ঘাটতি রয়েছে। একজন ভালোভাবে বিশ্রাম নেওয়া ব্যক্তি বিরক্তিকর পরিবেশেও ঘুমিয়ে পড়বেন না,” বলেন শিকাগোর নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ফেইনবার্গ স্কুল অফ মেডিসিনের স্নায়ুবিজ্ঞান ও প্রতিরোধমূলক চিকিৎসার সহযোগী অধ্যাপক ড. ক্রিস্টেন নুটসন।
তিনি আরও বলেন, “দিনের বেলা অতিরিক্ত ঘুম কর্মক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এবং ঘুমের কোনো গোপন সমস্যা বা অন্যান্য স্বাস্থ্য জটিলতার ইঙ্গিত হতে পারে। যদি কেউ নিয়মিত এমন সমস্যায় পড়েন, তবে অবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত।”
ঘুমের ঘাটতির একটি অদৃশ্য বিপদ রয়েছে—যখন শরীর নিজেকে জাগিয়ে রাখতে অজান্তেই নানা উপায় খোঁজে। যেমন—অতিরিক্ত হাই তোলা, মনোযোগ ধরে রাখতে অসুবিধা হওয়া ইত্যাদি। তবে এই চিহ্নগুলোকে উপেক্ষা করলে সমস্যা আরও বেড়ে যেতে পারে, বলেন AASM বোর্ড সদস্য ও গবেষণাপত্রের অন্যতম লেখক এবং ফিলাডেলফিয়ার পেন মেডিসিন ভেটেরান্স অ্যাডমিনিস্ট্রেশন মেডিকেল সেন্টারের ঘুম বিশেষজ্ঞ ড. ইন্দিরা গুরুভাগবতুলা।
“সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হল, দীর্ঘদিন আংশিক ঘুমের ঘাটতি আমাদের নিজের দুর্বলতা বোঝার ক্ষমতাকে হ্রাস করে—আমরা ভাবি আমরা ঠিক আছি, অথচ বাস্তবে তা নই,” বলেন ড. ইন্দিরা গুরুভাগবতুলা।
“যখন আমরা মস্তিষ্কের কার্যকারিতা মূল্যায়নের জন্য পরীক্ষা চালাই—যেমন প্রতিক্রিয়ার গতি, স্মরণশক্তি, সমন্বয় ক্ষমতা ইত্যাদি—তখন আমরা দেখতে পাই মানুষ প্রচুর ভুল করছে।”
“আর সমস্যার জায়গাটা হল, তারা নিজেরাই বুঝতে পারে না তারা ভুল করছে, বরং মনে করে সব ঠিকঠাক চলছে।”
গুরুভাগবতুলা আরও বলেন, ঘুমের ঘাটতি চলতে থাকলে, মস্তিষ্ক স্বল্প সময়ের জন্য বিশ্রাম নিতে শুরু করে—এটিকে বলা হয় মাইক্রোস্লিপ।
“মস্তিষ্ক কয়েক সেকেন্ডের জন্য ঘুমিয়ে পড়ে—হয়তো ২, ৩ বা ১০ সেকেন্ড—তারপর আবার জেগে ওঠে। আপনি হয়তো বুঝতেও পারবেন না যে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।”
“এটি তখনই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে যখন আপনি গাড়ি চালাচ্ছেন বা এমন কোনো কাজ করছেন যেখানে মনোযোগ ও নিরাপত্তা অপরিহার্য। তাই যদি মনে হয় ঘুম এসে যাচ্ছে, সেটা উপেক্ষা না করে গুরুত্ব দিন—এটি আপনার নিরাপত্তার জন্য সতর্কবার্তা।”
উল্লেখযোগ্য পরিসংখ্যান বলছে, বছরে প্রায় ১,০০,০০০ সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে রয়েছে ঘুমঘোরে গাড়ি চালানো।
ঘুমের মান যাচাই করবেন কীভাবে?
আপনার ঘুম যথেষ্ট হচ্ছে কিনা তা জানতে, বিভিন্ন উপায়ে মূল্যায়ন করা যায়—যার একটি জনপ্রিয় স্কেল হলো এপওয়ার্থ স্লিপিনেস স্কেল, বলেন গুরুভাগবতুলা।
এই স্কেলে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ঘুমিয়ে পড়ার সম্ভাবনা জিজ্ঞাসা করা হয়, যেমন—মদ্যপান ছাড়া দুপুরের খাবারের পর শান্তভাবে বসে থাকা, বিকেলে শুয়ে থাকা, পাবলিক প্লেসে নিরবভাবে বসে থাকা, পড়া, কারো সঙ্গে কথা বলা, গাড়িতে যাত্রী হিসেবে থাকা, ট্র্যাফিকে বসে থাকা বা টিভি দেখার সময়।
“এই আটটি পরিস্থিতিতে ঘুমিয়ে পড়ার সম্ভাবনা স্কেল অনুযায়ী শূন্য থেকে তিন পর্যন্ত নম্বর দিতে বলা হয়,” তিনি বলেন। “সর্বোচ্চ স্কোর ২৪, যেখানে ১০ এর ওপরে স্কোর পাওয়া গেলে আমরা সেটিকে গুরুত্বপূর্ণ ধরে হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করি।”
গুরুভাগবতুলা বলেন, ঘুমের অভাব বাড়তে থাকলে শারীরিক ও মানসিক সতর্কতা হ্রাস পেতে থাকে।
“চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে, শরীর ঝিমিয়ে পড়ে, সোজা হয়ে বসে থাকা কঠিন হয়। কেউ কেউ মাথা ঘোরার অনুভূতি, কাঁপুনি বা ভারসাম্য হারানোর কথাও বলেন।”
“এমনকি অনেক সময় মানুষের আচরণ পরিবর্তিত হয়—তারা বেপরোয়া বা অস্বাভাবিক আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। এটিও ঘুমের চরম ঘাটতির একটি লক্ষণ।”
ঘুমঘোরের পেছনে লুকানো কারণ
ঘুমঘোর বা দিনের বেলার তন্দ্রাচ্ছন্নতার পেছনে নানা ধরনের শারীরিক বা মানসিক কারণ থাকতে পারে—যেমন স্লিপ অ্যাপনিয়া, অনিদ্রা, রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম বা সার্কাডিয়ান রিদম ডিসঅর্ডার। তাছাড়া দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা বা কিছু ওষুধও এর জন্য দায়ী হতে পারে, যা ঘুম বিশেষজ্ঞ যাচাই করে থাকেন।
“আপনার ব্যবহৃত প্রেসক্রিপশন ওষুধ সম্পর্কে আপনার ফার্মাসিস্টের পরামর্শ নেওয়া উচিত,” বলেন গুরুভাগবতুলা। “এমনকি ওভার-দ্য-কাউন্টার যেসব ওষুধ আপনি নিজে নেন, সেগুলোকেও বিবেচনায় রাখা জরুরি।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, কিছু সাধারণ জীবনধারা ও আচরণও দীর্ঘমেয়াদি তন্দ্রাচ্ছন্নতার পেছনে বড় ভূমিকা রাখে।
“অনিয়ন্ত্রিতভাবে ক্যাফেইন গ্রহণ, ঘুমানোর আগে অ্যালকোহল বা গাঁজা সেবন, অনিয়মিত ব্যায়াম, এবং দুর্বল ঘুম-স্বাস্থ্য রুটিন—যেমন অতিরিক্ত আলো, ঠাণ্ডা বা গরম পরিবেশ, অথবা শব্দযুক্ত কক্ষে ঘুমানো—এসবই আপনার ঘুমের গঠন ও বিশ্রামের মানকে প্রভাবিত করে,” বলেন ড. গুরুভাগবতুলা।
তিনি জানান, অনেকে ভুলভাবে বিশ্বাস করেন অ্যালকোহল বা গাঁজা ঘুমের জন্য সহায়ক, অথচ বাস্তবে তা উল্টো প্রভাব ফেলে।
“যদিও অ্যালকোহল প্রাথমিকভাবে ঘুমিয়ে পড়া সহজ করে, এটি শরীরে বিপাকিত হওয়ার পর মাঝরাতে জেগে ওঠার সম্ভাবনা বাড়ায়,” তিনি ব্যাখ্যা করেন।
“আমার কিছু রোগী রয়েছেন যারা বলেন, রাতের খাবারের সঙ্গে মাত্র একটি পানীয় তাদের ঘুম ভালো করতে সাহায্য করে—তাদের এই বিশ্বাস আমাকে বিস্মিত করে,” বলেন গুরুভাগবতুলা।
“গাঁজার ক্ষেত্রেও আমরা দেখতে পাই, এটি ঘুমের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ঘুমের গুণমান কমে যায় এবং পরদিন সকালে মানুষ আরও ক্লান্তি অনুভব করেন। ফলে, শেষ পর্যন্ত ঘুমের প্রকৃত মান হ্রাস পেতে শুরু করে।”