Close

“জল, পাহাড় আর বন্ধুত্ব”

"জল, পাহাড় আর বন্ধুত্ব"

"জল, পাহাড় আর বন্ধুত্ব"

ঢাকার ব্যস্ততা, জ্যাম আর ক্লান্তিকর ক্লাস পরীক্ষার রুটিনের ভেতর থেকে একটা নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা খুঁজছিলাম আমরা পাঁচজন অনেকদিন ধরেই। সে অনেক প্ল্যান কই যাওয়া যায় দূরে কোথাও অন্তত ১/২ দিনের জন্য। শেষমেশ এক চায়ের আড্ডায় এটা সিদ্ধান্ত হল আমরা রাঙ্গামাটি যাচ্চি, যেই কথা সেই কাজ ২দিনের মধ্যেই আমরা আমাদের ব্যস্ততম রুটিন থেকে বের হয়েই রওনা দিলাম রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে। আমি (যাকিয়াহ), বন্ধু নোবেল, মুন্তাহা, জয়ন্ত আর মেহরাজুল। আমি বাদে বাকি ৪ জনই আমার ভার্সিটির অন্য ডিপার্ট্মেন্টের। বন্ধুত্বটা যেন আরও জমে গেল—”চল, রাঙ্গামাটি যাই” এই কথায়।

ভার্সিটির সামনে সবাই একত্রিত হলাম এবং ভার্সিটির বাসে চলে গেলাম কলাবাগান বাস কাউন্টারে। এবং সেখান রাতের বাসে ঢাকা থেকে রওনা দিলাম। শ্যামলি বাসে বসে জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকারে ডুবে যাওয়া শহর দেখছিলাম আমরা। কেউ গান শুনছে, কেউ স্ন্যাক্স খাচ্ছে, কেউ আবার গল্প করছে। ভ্রমণের আনন্দে কারও চোখে ঘুম নেই। মুন্তাহা বলল, “শুধু পাহাড় না, নাকি আমরা কাপ্তাই লেকে নৌকা নিয়েও ঘুরি?” মেহরাজুল সঙ্গে সঙ্গে বলল, “চিল মারবো লেকের মাঝখানে!”— সবাই হেসে উঠল।

সকালে যখন রাঙ্গামাটি পৌঁছালাম তখন ভোর ৫ টা এবং ওই সময় সূর্যের আলো লেকের জলে পড়ছে ঝিলিক দিয়ে। যেন ঢেউয়ের গায়ে আলো নাচছে। শহরটা যেন শান্তির একটা পেইন্টিং—পাহাড়ের কোলে, লেকের পাশে। কিছু কিছু ছোট নৌকা দেখা যাচ্ছিলো, এত সকালেও পাহাড়ী মানুষের জীবন শুরু হয় এটাই ভাবছিলাম।

একটা হোটেল আগে থেকেই বুক করা ছিল লেকপাড়ে। জানালা খুলতেই দিগন্ত বিস্তৃত কাপ্তাই লেক, দূরে সবুজ পাহাড় আর মাঝখানে ছোট ছোট নৌকা ভেসে বেড়াচ্ছে। আমরা একে একে রিফ্রেশ হয়ে হোটেলের পাশে থাকা এক দোকানে সকালের নাস্তা সেরেই লেকপাড়ের ঘাটে গেলাম এবং তখন এক ভদ্র লোক ২/৩ টা কার্ড আমাদের দিয়ে জানালো নৌকা লাগলে যেন তাকে জানাই আমাদের কিছু টাকা ডিসকাউন্টও দিতে পারেন বললেন। আমরা কিছুক্ষণ এলাকায় হেঁটে রুমে ফিরলাম একটু রেস্টের জন্য কারণ সারারাত আমরা কেউই ঘুমাইনি।

Rangamati (8)
Rangamati

নৌকায় দিনভ্রমণ

সকাল ৮ঃ৩০ এর দিকে ওই কার্ড এর ভদ্রলোককে কল দিয়ে একটা মাঝারি আকারের ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া নিলাম পুরো দিনের জন্য ২১০০ টাকা দিয়ে। নৌকায় উঠতেই এক অন্যরকম অনুভব—চারপাশে শুধু পানি, দূরে পাহাড়, আর আমরা পাঁচজন যেন এক নতুন জগতে পা রাখলাম।

নৌকায় বসেই সবাই মোবাইল বের করে ছবি তুলছে, কেউ ভিডিও করছে, কেউ সেলফি। নোবেল এক পর্যায়ে হেসে বলল, “এই ট্রিপের নাম দেয়া উচিত ‘ফাইভ ইন দ্যা ফ্লোট’!”—নামটা আমাদের পছন্দ হয়ে গেল।

প্রথম গন্তব্য ছিল বৌদ্ধ স্বর্নমন্দির, সেখানে পৌঁছানোর পর মাঝি আমাদের জানালো এখানে ৩০ মিনিট ব্রেক। আমরা ঘাটে নেমে মাত্রই উপরের দিকে উঠা শুরু করলাম, কিছুদূর উঠেই দেখালাম চাকমা আদিবাসীদের ছোট ছোট কিছু দোকান  আমরা সেখান থেকে পাহাড়ি আনারস, পেঁপে, ডাব কিনে খেতে খেতে আবারও উপরের দিকে উঠা শুরু করলাম আর পৌঁছে গেলাম মন্দিরের সামনে। কিছুক্ষন আদিবাসী লোকদের সাথে গল্প করে চলে আসলাম নৌকায়। 

Rangamati (7)

এরপর গেলাম শুভলং ঝরনা। নৌকায় প্রায় ৪৫ মিনিট লেগে গেল, কিন্তু পুরো রাস্তা যেন স্বপ্ন। একপাশে সবুজ পাহাড়, অন্য পাশে নীলজল। মাঝপথে একটা জায়গায় আমরা সবাই নেমে পানিতে পা ভিজালাম। জয়ন্ত হঠাৎ পানিতে ছিটিয়ে দিলো মুন্তাহার দিকে—আর শুরু হলো জলকেলি। নোবেল বলল, “আমরা আসলে বড় হইনি, শুধু স্কুলব্যাগ ফেলে এসেছি।”

শুভলং ঝরনায় পৌঁছে আমরা হাঁটুসমান পানির নিচে দাঁড়িয়ে ঝরনার নিচে গোসল করলাম। সেই ঠাণ্ডা পানির ছোঁয়া যেন সব ক্লান্তি ধুয়ে নিয়ে গেল। ঝরনার গা ঘেঁষে পাহাড় বেয়ে একটু ওপরে উঠতেই এক মনোরম দৃশ্য—কাপ্তাই লেককে পেছনে রেখে ঝরনার গর্জন, একদিকে নীল, অন্যদিকে সবুজ।

Rangamati (4)
Rangamati

পেদা টিং টিং এবং দুপুরের খাবার

ঝরনা দেখে আমরা আবার নৌকায় উঠলাম এবং যাত্রা শুরু করলাম পেদা টিং টিং রেস্টুরেন্টের দিকে। এটা একটা ভাসমান রেস্টুরেন্ট—লেকের মাঝখানে। চারপাশে পানি, মাঝখানে কাঠের একটা কাঠামো আর সেখানে বসে খাওয়া!

আমরা সবাই খেতে অর্ডার করলাম ব্যাম্বু চিকেন, আদা ফুল দিয়ে মাছ ভর্তা, লেকের চাপিলা মাছ, বাঁশকোরল ফ্রাই, ডাল আর লেবু মরিচ দিয়ে দারুণ এক লালচে টক-ঝাল ভর্তা। খেতে খেতে জয়ন্ত বলল, “পানির মাঝে এমন স্বাদে খাওয়া… এটা এক্সপেরিয়েন্স!”

খাওয়ার পর আমরা সবাই লেক দেখতে দেখতে পেছনে বসে কিছুক্ষণ গান গাইলাম। হালকা বাতাসে সবার কণ্ঠে “এই পথ যদি না শেষ হয়…” যেন ভেসে যাচ্ছিল দূরে, পাহাড় ছুঁয়ে।

Rangamati (3)
Rangamati

লেকের গভীরে হারিয়ে যাওয়া

দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামছে। আমরা তখন একটা নির্জন জায়গায় নৌকা থামিয়ে বসে ছিলাম। কেউ কিছু বলছে না—শুধু বাতাস, হালকা ঢেউ আর পাখির শব্দ। সেই নিরবতায় মেহরাজুল বলল, “জীবনে কিছু কিছু মুহূর্ত থাকে, যা কোনো ক্যামেরায় বন্দি করা যায় না। শুধু মনে গেঁথে যায়।” আমরা সবাই চুপ করে মাথা নেড়ে বললাম, “হ্যাঁ।”

এরপরে আমরা চলে গেলাম সেই বিখ্যাত ঝুলন্ত ব্রিজে। কত কত মানুষ আর আমরাও যেন তার ব্যাতিক্রম নই একটুও। কিছুক্ষণ ঘুরাফিরা, খাওয়া-দাওয়া আর ছবি তুলেই আবারও নৌকায় উঠে পরলাম।

Rangamati (2)
Rangamati

শেষ বিকেলের সূর্য ও ফেরার পথ

সূর্য যখন ডুবে যাচ্ছিল, লেকের জলে তার প্রতিচ্ছবি যেন আগুন রঙের একটা চাদর ছড়িয়ে দিচ্ছিল। আমরা সবাই তখন নৌকার ছাদে বসে সূর্যাস্ত দেখছিলাম। মুন্তাহা বলল, “এই জায়গাটা আমার একটা ‘হ্যাপি প্লেস’ হয়ে থাকবে।” নোবেল চোখে সানগ্লাস পরে বলল, “আমাদের বন্ধুত্বের পেছনেও এখন একটা দৃশ্য আছে—এই সূর্যাস্ত।”

ফেরার সময় নৌকা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিল পলওয়েল পার্কের ঘাটের দিকে, আর আমরা যেন একটু একটু করে বাস্তবে ফিরছিলাম। পলওয়েল পার্কে সারা সন্ধ্যাটা পার করলাম, চারদিকে লেক আর বাতাস এ যেন এক শান্তির যায়গা। এরপর সিএনজি করে সবাই হোটেলে বেক করলাম। ফ্রেশ হয়ে সবাই আবারও লেক পাড়ের বাজার মার্কেটগুলাতে গিয়ে কিছু কেনাকাটা করলাম। রাতে আবারও খাওয়া দাওয়া করলাম সকালের খাবারের দোকানটায়। দোকানের মালিক কর্মচারীরা আমাদের খুব আপ্যায়ন করেছিলো তাদের আন্তরিকতা ভূলার মত নয়। সেই রাতে হোটেলে ফিরে সবাই অনেক ক্লান্ত ছিল, কিন্তু মনে একরাশ শান্তি। ঘরে ফিরে যখন বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করলাম, তখন চোখের সামনে ভেসে উঠল কাপ্তাই লেকের ঢেউ, শুভলং ঝরনা, পলওয়েল পার্ক  আর সেই পেদা টিং টিং-এ খাওয়া সব খাবার।

Rangamati
Rangamati

এই ট্রিপটা কেবল একটা ঘোরাঘুরি না, বরং একটা বন্ধুত্বের নতুন অধ্যায়—যেখানে পাহাড়, লেক আর আকাশ ছিল সাক্ষী। আবারও হারিয়ে যেতে মন চায় এই কোনো পাহাড় বা লেক/ সমুদ্রের পাড়ে।

আর্টিস্ট এবং লেখক

4 Comments

  1. অনেক অনেক সুন্দর হয়েছ লেখা, ভ্রমণ কাহিনীর মূল ভিত্তি হলো পাঠকের কাছে শুধু লেখা দিয়ে চোখের সামনে কোন স্থান কাল বা সময় কে নিখুঁত করে ফুটিয়ে তোলা, সেটা শতভাগ সফল হয়েছে তাই লেখাও সফল। শুভ কামনা রইলো।

    1. আপনার এতো সুন্দর মন্তব্য পড়ে সত্যিই মন ভরে গেল। আপনি যেভাবে অনুভব করেছেন, সেটাই ছিল লেখার মূল লক্ষ্য -পাঠকের মনে সেই জায়গাটিকে জীবন্ত করে তোলা। আপনার শুভকামনার জন্য হৃদয় থেকে ধন্যবাদ।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

4 Comments
scroll to top