Close

কালে কালে নারীবাদের ঢেউ

নারীবাদ

নারীবাদ কী, কেনো, কীভাবে, কোথায় যাচ্ছি?

ইতিহাসের গোড়া থেকেই নারী ও পুরুষের মাঝে পার্থক্য বিদ্যমান। হাজার বছর ধরে এর বিরুদ্ধে কোন আর্গুমেন্ট ছিলো না। ধীরে ধীরে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে উঠতে শুরু করলো; কখনো হালকা কখনোবা তীব্রভাবে। এই আন্দোলন মূলত গড়ে উঠতে থাকে পুরুষের নারীদের কাজকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার কারণে এবং মানবজাতির সার্বাইভাল রেসে এবং দেশের অর্থনীতিতে নারীর ঘরের এসব কাজ কোনো অবদান রাখে না বিধায়। পুরুষদের শারীরিক সক্ষমতা, ঘরের বাইরে কাজ করার অভ্যাস এবং সন্তান লালন-পালনের দ্বায়িত্ব থেকে মুক্তি তাদের উগ্র স্বভাবের করে তুললো এবং নারীদের সামনে তাদের দাম্ভিক করে তুললো। এই দৃশ্যপট এটাই প্রমাণ করে যে সকল সামাজিক নিয়ম-রীতিনীতি মূলত পুরুষদের তৈরী এবং তা পুরুষতান্ত্রিকতার জয়জয়কার করছিলো পাশাপাশি নারীদের জীবনেও পুরুষরা অপ্রয়োজনীয়, অনৈতিক হস্তক্ষেপ করছিলো। হিউম্যান রেসে নারীরা ছিলো মূলত পুরুষের ‘প্যাসিভ পার্টনার’।

এই হীন লিঙ্গগত পার্থক্য ঘুচিয়ে দিতে এবং পুরুষ ও নারীর মাঝে সমতা আনার জন্য যে দাবী গড়ে উঠে তাকে নারীবাদ বলে।

-এতোটুকু হচ্ছে মুখস্থ বুলি যা আমরা সকল প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দেখতে পাই এবং এসব তত্ত্ব আমাদের মুভি হতে শুরু করে মিনার কার্টুন দ্বারাও গেলানো হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে খুবই যৌক্তিক ও মধুর কথা। কিন্তু নারীবাদের এটা হলো ‘আর্টিফিসিয়াল ফেস’। তার ‘রিয়েল ফেস’ দেখতে হলে আমাদের একটু পেছন থেকে শুরু করতে হবে-

.

১। নারীবাদের মূল প্রোথিত রয়েছে ‘সেক্যুলারিজম’ ও ‘অ্যাথিজম’-এ। অর্থাৎ নারীবাদী হওয়ার প্রথম শর্ত আপনাকে সেক্যুলার ও নাস্তিক হতে হবে। কোনো ধর্মই নারীবাদ সাপোর্ট করে না।

সেক্যুলারিজম ও অ্যাথিজমের উৎপত্তি মোটাদাগে ইউরোপ ও আমেরিকায়। মধ্যযুগে ইউরোপে ক্যাথলিক চার্চের নৈতিক অধঃপতন, দুর্নীতি এবং খ্রিষ্টানদের মধ্যকার রক্তক্ষয়ী নানা বিরোধে ধর্মের প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণা জন্মে ইউরোপীয়দের মাঝে যার প্রেক্ষাপটে জন্ম হয় সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। যাকে ‘এনলাইটেনমেন্ট’ ও বলা হয়ে থাকে।

এর কাছাকাছি সময়ে ডারউইন ‘অরিজিন অব স্পিসিজ’ গ্রন্থের মাধ্যমে ‘বিবর্তনবাদ’-এর ধারণা দিলে ইউরোপীয়রা কার্যত ধর্মকে নক আউট করে দেয়। রাষ্ট্রযন্ত্র ধর্ম থেকে আলাদা হয়ে ‘সেক্যুলারিজম’কে আকড়ে ধরে। মনুষ্য তৈরী নৈতিকতার ভিত্তিতে পরিচালিত হতে থাকে রাষ্ট্র।

২। ইউরোপ পৃথিবীর প্রায় ৮৫% শতাংশ দখল করে ফেলে এবং ‘সভ্য-সাদা’ মানুষরা লুটপাট করে সকল সম্পদ ইউরোপে জমা করতে থাকে। আমেরিকায় ‘অসভ্য’ রেড ইন্ডিয়ানদের তাদেরই জন্মভূমিতে গণহত্যা করে ও আফ্রিকার ‘অসভ্য কালো মানুষদের’ দাস করে ইউরোপীয়ান লুটপাট স্টাইলে সম্পদের পাহাড় গড়ে উঠতে থাকে। যাদের ‘অসভ্য’ আখ্যা দিয়ে জোর করে ‘সভ্য’ করার দায়িত্ব ‘মহান’ ইউরো-আমেরিকানরা কাঁধে নিলো পরবর্তীতে দেখা গেলো তারাই ‘সভ্য, শ্লীল ও সৎ’।

৩। ইউরোপের উপনিবেশ হওয়ার কারণে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের মানুষের মাঝে তৈরী হয় মানসিক দাসত্ব। পরবর্তীতে ইউরোপীয় শাসন থেকে মুক্ত হলেও মানসিক দাসত্ব থেকে তারা মুক্তি পায় নি। ইউরোপ আমেরিকা তাদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলেও মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকল। মানসিক দাসত্বের স্বীকার জাতিগুলো নিজেদের সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার ভুলে ইউরোপ আমেরিকার সংস্কৃতিকেই ভেবে নিলো চিরন্তন ও সর্বোন্নত।

৪। পুঁজিবাদী অর্থনীতি শেকড় গেড়ে বসার পর পুঁজিপতিরা টের পেলো শুধু পুরুষ শ্রমিকে তাদের পোষাবে না। কলকারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য তারা নারীদেরও তাদের শ্রমিক শ্রেণীতে পরিণত করার প্রয়োজন অনুভব করলো। কিন্তু নারীরা ঘর ছেড়ে বেরোতে চাইলো না। তারা তখন অবধি বুঝতো সমাজ বিনির্মাণে তাদের সবচেয়ে বেশি অবদান রয়েছে এবং তা একটি সুন্দর-সুস্থ পরিবার গঠনের মাধ্যমেই কেবল সম্ভব। কিন্তু পুঁজিপতিরা থামলো না। গালভরা বুলি নিয়ে আগমন ঘটালো ‘নারীবাদ’-এর। নারীদের বুঝালো ‘ঘর হলো জেলখানা; তোমরা বেরিয়ে এসো’। নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে ভুল বুঝিয়ে তাদের পুঁজিবাদের নোংরা মাঠে নামিয়ে আনা হলো। তাদের বুঝানো হলো ‘নারীদেরও পুরুষ হতে হবে’।

৫। মানসিক দাসত্বের স্বীকার পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মানুষগুলো ইউরোপীয়দের অন্যান্য তত্ত্বের মতো নারীবাদকেও ‘মহান’ কোন তত্ত্ব ভেবে আঁকড়ে ধরলো।

ভেঙে পড়তে থাকলো কথিত ‘পিছিয়ে পড়া’ জনগোষ্ঠীদের সমাজের ভারসাম্য। নারীদের করে তোলা হলো লবণের মতো। শেভিং ক্রিম, ইট, সিমেন্ট, টিভি, মোবাইল সবকিছুর বিজ্ঞাপনে সস্তা পণ্যের মতো তাদের দেদারসে কাপড় খুলে তুলে ধরতে থাকলো। স্বামীর যৌন চাহিদাকে ‘ম্যারিটাল রেপ’ আখ্যা দিয়ে তাদের বিবাহের প্রতি নিরুৎসাহিত করে কর্পোরেট দাসী-তে পরিণত করে রাঘব বোয়ালদের মনোরঞ্জনের উপাদান করা হলো এবং তাদের বুঝানো হলো, ‘এটাই স্বাধীনতা’।

৬। ‘অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে ঘরে আটকে রেখে এগিয়ে যাওয়া যাবে না’ টাইপ যুক্তি দিয়ে বলা হলো নারীদের বাইরে কাজ করতে দেয়া উচিত, এতে আমরা ইউরোপ আমেরিকার মতো সম্পদশালী হবো। এরা হয়তো জানে না ইউরোপ আমেরিকা পৃথিবীব্যাপাী গত এক শতাব্দী ধরে লুটপাট, খুন, ধর্ষণ, চুরি, রাহাজানি করে পৃথিবীর সকল সম্পদ জমা করেছে। নারীদের কথিত কাজের স্বাধীনতা দিয়ে যদি ভাবা হয় যে তাদের সমান সম্পদের অধিকারী হয়ে যাবো তা মূর্খতা। এতে জিডিপির হালকা হেরফের হলেও কখনোই ইউরোপ আমেরিকার মতো ‘অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি’ অর্জন সম্ভব না বা বলা যায় তারা আমাদের তাদের সমান হতে দিবে না।

৭। নারীবাদ খুব সূক্ষ্ম কৌশলে নারীদের ঘরের কাজকে অশ্রদ্ধা করছে। অর্থাৎ তারা এমন সব তত্ত্ব কথা বলে থাকে যা থেকে মনে হয় সন্তান লালন পালন, একটি পরিবারকে সুন্দর রাখা কোন কাজই নয়। পুঁজিবাদের একটি শ্রেণী হিসেবে তৈরী হওয়ায় প্রত্যেকটা কাজকেই অর্থের দাড়িপাল্লায় মাপার স্বভাব রয়েছে তাদের। তারা বুঝেনা বা বুঝতে চায় না যে একটি সুস্থ সুন্দর পরিবার গড়ে তোলা ও সন্তানের মাঝে নীতি নৈতিকতার সুষ্ঠু বিকাশ ঘটানোয় একজন নারীর যে অবদান তাকে অর্থের মাপকাঠিতে মাপা যায় না; যেমন মাপা যায় না আমাদের জীবনধারণের অতি গুরুত্বপূর্ণ অক্সিজেনের দাম। এগুলো গভীরে উপলদ্ধির বিষয়।

ফেমিনিজম একটা ভ্রান্ত ধারণা যার বিস্তৃতি বিশাল। এই ‘বিশাল ভ্রান্ত ধারণা’-র বিরুদ্ধে লিখতে বসলে অনেক কথাই বলতে হয়। আফসোসের বিষয় আমরা নারীবাদের কদর্য রূপ এখনো ধরতে পারিনি বা ধরতে পারলেও এর বিরুদ্ধে কিছু করতে পারছি না।

পরিবারকে আমি একটা উত্তাল সমুদ্রে নৌকার মতো দেখি। সেই নৌকায় নারী পুরুষ একে অপরের পরিপূরক। পুরুষ নৌকার দাঁড় বাইবে নারী শক্ত হাতে হাল ধরে তার গন্তব্য ঠিক রাখবে।

নারীবাদের এতোসব নেগেটিভিটি প্রকাশ পাওয়ার পর এখন আমাদের ভাবা দরকার যাকে আমরা ‘নারীবাদী’-দের দাবি বলি তা কি আসলেই ‘নারী’-দের কোনো উপকার করছে কী না, নাকি নারীদের সহজাত বৈশিষ্ট্যকে বিলুপ্ত করে সমাজের মূলে পচন ধরাচ্ছে?

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Leave a comment
scroll to top