বাংলাদেশ ও ভারত দুটি পার্শ্ববর্তী দেশ, যাদের মধ্যে রয়েছে দীর্ঘস্থায়ী ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক। তবে এই সম্পর্কের মধ্যে রয়েছে কিছু জটিলতা, যার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সীমান্ত সমস্যা। প্রায় ৪,০৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সীমান্ত পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘতম ভূমি সীমান্ত। এই সীমান্তে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, যেমন সীমান্ত হত্যা, অনুপ্রবেশ, চোরাচালান, পানি সম্পদের বিতর্ক, এবং এনক্লেভ সংক্রান্ত জটিলতা। এই প্রবন্ধে সীমান্ত সমস্যা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে, এর কারণ, প্রভাব এবং সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে বিশ্লেষণ করা হবে।
১. সীমান্ত নির্ধারণ ও এনক্লেভ সমস্যা:
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত নির্ধারণ একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ফল। ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের সময় র্যাডক্লিফ লাইন ভিত্তিতে এই সীমান্ত নির্ধারিত হয়। কিন্তু এই সীমান্ত রেখা অনেক সময় স্বচ্ছ ছিল না, ফলে দুই দেশের মধ্যে এনক্লেভ বা ছিটমহলের সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ, এক দেশের মধ্যে অন্য দেশের ভূখণ্ড অবস্থিত ছিল। বাংলাদেশে ভারতের ছিটমহল এবং ভারতে বাংলাদেশের ছিটমহল – এই জটিল অবস্থান স্থানীয় জনগণের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করেছিল।
এই সমস্যা নিরসনে ২০১৫ সালে ভারত ও বাংলাদেশ ঐতিহাসিক সীমান্ত চুক্তি সম্পাদন করে, যার ফলে দুই দেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় সম্পন্ন হয়। এতে প্রায় ৫০,০০০ মানুষ নাগরিকত্ব লাভের সুযোগ পায় এবং সীমান্ত এলাকার রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা অনেকটাই ফিরে আসে।
২. সীমান্ত হত্যা ও বিএসএফ-এর ভূমিকা:
সীমান্ত হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সবচেয়ে সংবেদনশীল ইস্যুগুলোর একটি। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (BSF) প্রায়ই বাংলাদেশি নাগরিকদের গুলি করে হত্যা করে, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করে। ভারতের দাবি হলো, এই হত্যা চোরাচালান, গবাদিপশু পাচার বা অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে হয়েছে। তবে, বাংলাদেশি মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো এসব হত্যাকাণ্ডকে বিচারবহির্ভূত বলে অভিহিত করে থাকে।
সীমান্ত হত্যা বন্ধে দুই দেশের মধ্যে বহুবার আলোচনা হয়েছে এবং কিছু প্রোটোকল স্বাক্ষরিত হলেও বাস্তবে এই সমস্যা পুরোপুরি নির্মূল হয়নি। এই হত্যাকাণ্ড শুধু দুই দেশের সম্পর্ককে প্রভাবিত করে না, বরং সীমান্ত অঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করে।
৩. চোরাচালান ও অবৈধ অনুপ্রবেশ:
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত জুড়ে চোরাচালান একটি সাধারণ সমস্যা। গবাদিপশু, মাদকদ্রব্য, অস্ত্র, ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ও ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তে এসব কার্যকলাপ বেশি দেখা যায়।
চোরাচালান অনেক সময় সংঘর্ষের সৃষ্টি করে, যার ফলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। এছাড়া সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশ – বিশেষ করে রোহিঙ্গা বা বাংলাদেশি নাগরিকদের ভারতে প্রবেশ – রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়, বিশেষ করে ভারতের নির্বাচনী রাজনীতিতে। এর ফলে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও পারস্পরিক বিশ্বাসের ক্ষতি হয়।
৪. নদীভিত্তিক সীমান্ত সমস্যা ও পানি বণ্টন:
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নদীভিত্তিক সীমান্ত সমস্যাও রয়েছে। অনেক সীমান্ত নদীর গতিপথ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়, ফলে নদীর পাড় ভেঙে সীমান্ত রেখা অস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এর ফলে জমি দখল বা জমি সংক্রান্ত বিরোধ তৈরি হয়।
গাজা (GAZA) কি মানচিত্র থেকে মুছে যাচ্ছে ?
এছাড়া, তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছে। বাংলাদেশ চায় শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানি ভাগ করে নিতে, যাতে উত্তরবঙ্গের কৃষি খাত সচল রাখা যায়। যদিও ২০১১ সালে একটি চুক্তির খসড়া তৈরি হয়েছিল, কিন্তু ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক জটিলতার কারণে এটি এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে সীমান্ত অঞ্চলের কৃষকরা প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে পানি সংকটে ভোগে।
৫. নিরাপত্তা ও সীমান্ত ব্যবস্থাপনা:
সীমান্ত ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাও একটি বড় সমস্যা। অনেক জায়গায় কাঁটাতারের বেড়া নেই, ফলে অবৈধ চলাচল সহজ হয়ে যায়। আবার যেসব এলাকায় কাঁটাতার রয়েছে, সেখানে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কখনো কখনো অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করা হয়।
দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী যৌথ টহল, তথ্য আদান-প্রদান ও যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হলেও অনেক সময় এসব পদক্ষেপ কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকে। স্থানীয় প্রশাসন ও সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং দুর্নীতি সীমান্ত সমস্যা জিইয়ে রাখে।
৬. সীমান্তবাসীর জীবনযাত্রা ও মানবাধিকার:
সীমান্ত অঞ্চলের মানুষের জীবন দুর্বিষহ। সীমান্ত হত্যা, অনুপ্রবেশের ভয়, বিএসএফ বা বিজিবির তল্লাশি, এবং চোরাচালানের কারণে তাদের জীবন প্রায়শই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থাও পিছিয়ে রয়েছে এসব এলাকায়। অনেকে চোরাচালানে জড়িয়ে পড়ে বাধ্য হয়ে, যা তাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দেয়।
এছাড়া, অনেক সময় নিরপরাধ ব্যক্তিকেও অপরাধী হিসেবে সন্দেহ করা হয়। শিশু ও নারীরাও নানা ধরনের হয়রানির শিকার হয়। এসব বিষয়ে মানবাধিকার রক্ষা ও আইনি সহায়তা অত্যন্ত জরুরি।
২০২৫ সালে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত ইস্যু আবারও উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। সম্প্রতি সীমান্তে বেড়া নির্মাণ, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, এবং সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সামরিক তৎপরতা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বেশ বেড়া নির্মাণের উদ্যোগ নিচ্ছে, যা বাংলাদেশে উদ্বেগ তৈরি করেছে। বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ কয়েকটি সীমান্ত এলাকায় এই কাজ শুরু করায় ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করে বাংলাদেশ সরকার কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে
উভয় দেশের মধ্যে আগেই চুক্তি ছিল যে শূন্যরেখা থেকে ১৫০ গজের মধ্যে কোনো প্রতিরক্ষা কিংবা অবকাঠামোগত কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না, বা করতে হলে পরস্পরের সম্মতি প্রয়োজন হবে। শূন্যরেখার কাছাকাছি এলাকায় অস্ত্র বহন, সড়ক নির্মাণ বা স্থায়ী স্থাপনা তৈরির ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু এসব চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে সম্প্রতি আবার প্রশ্ন উঠেছে।
রাজনৈতিকভাবে বিষয়টি আরও জটিল হয়েছে, কারণ বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ-আসাম অঞ্চলে রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তপ্ত, এবং সীমান্ত ইস্যুটি মাঝে মাঝে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে।

🔹 সাম্প্রতিক কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া (২০২৫)
- বাংলাদেশ সরকার ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে, বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে বেড়া নির্মাণ এবং মাটি খোঁড়ার ঘটনার প্রেক্ষিতে।
- একই সময়ে ভারত বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশনার নূরুল ইসলামকে তলব করে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে এবং “অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার” দোহাই দেয়।
- বিজিবি ও বিএসএফ-এর মধ্যে ব্যাটালিয়ন কমান্ডার পর্যায়ের পতাকা বৈঠকও হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ সীমান্ত নির্দেশাবলি লঙ্ঘনের বিষয়টি তোলে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য প্রভাব
- সীমান্ত বেড়া নিয়ে চলমান কার্যক্রম অব্যাহত থাকলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নতুন করে টানাপোড়েন বাড়তে পারে।
- শূন্যরেখার নিকটে স্থাপনা নির্মাণ বা কার্যক্রম ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগে পরিণত হতে পারে।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত সমস্যা শুধু দুই দেশের মধ্যে একটি ভূ-রাজনৈতিক ইস্যু নয়, এটি মানবিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত। শান্তিপূর্ণ ও সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা দুই দেশের জন্যই কল্যাণকর হবে। পারস্পরিক বিশ্বাস, নিয়মিত সংলাপ ও বাস্তবসম্মত নীতি গ্রহণের মাধ্যমে সীমান্ত সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। এই সমস্যা সমাধান হলে দুই দেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হবে।





