চারদিকে পুরোদমে চলছে নির্বাচনী প্রচারণা। আজ বাদে কালই জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আর এই নির্বাচনকে ঘিরে জনমনেও আছে নানা কৌতুহল। তবে এই কৌতুহল কে ক্ষমতায় আসবে তা নিয়ে নয়। বরং সবার কৌতূহল হচ্ছে নির্বাচনের দিন জনসাধারণের নিরাপত্তা ও বিরোধী দল বিহীন এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে। কারন নির্বাচনের মাঠে যে পরিস্থিতি বিরাজমান, তাতে অনেকেই সংঘাতের আশঙ্কা করছেন।
১. ডামি ও স্বতন্ত্রের বিড়ম্বনা
পূর্ববর্তী নির্বাচন গুলোতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে দল থেকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো। কিন্তু এবারের নির্বাচনে অবস্থা ঠিক বিপরীত। এবার দল থেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াতে আহ্বান করা হয় ও অন্যান্য জোটের প্রার্থীদের প্রতি সহযোগিতামূলক আচরণ করতে নির্দেশনা দেয়া হয়। এতে সারাদেশে প্রায় প্রতিটি আসনেই একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন। তবে দলীয় নির্দেশনা মেনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিলেও অনেকেই সহযোগিতামূলক আচরণ করার নির্দেশনাটি উপেক্ষা করে সংঘাতের পথেই হাঁটছেন। নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন সহ কিছু কিছু ক্ষেত্রে দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্ত প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের উপর একে অপরের নির্বাচনী সভা ও প্রচারণায় হামলা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু অভিযোগ উঠলেও এর প্রতিকার যে খুব বেশী একটা মেলেনি তা বিগত দিনের ঘটনা থেকে স্পস্ট। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে দলীয় স্বার্থ রক্ষার পরিবর্তে সবাই নিজ নিজ আধিপত্য বিস্তারকেই বেশী প্রাধান্য দিচ্ছেন। ফলে দিনশেষে জনগণের মাঝে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়েই চলছে। এসব ঘটনা প্রত্যক্ষ করে জনসাধারণের মনে একটাই প্রশ্ন জেগেছে, “দলীয় ও স্বতন্ত্রের এই রেষারেষির মধ্যে ভোটের দিন ভোটকেন্দ্র নিরাপদ থাকবে তো?”
২. প্রশাসনের দৃঢ় অবস্থান
জনগণের এতো উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মাঝে আশার আলো জাগাচ্ছে প্রশাসনের দৃঢ় অবস্থান। যেকোনো অপ্রীতিকর ঘটনা মোকাবেলা করে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রশাসন যে এবার আরও বেশি বদ্ধপরিকর, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। জনগণের প্রতি ভোট বর্জনের আহ্বান করে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো লিফলেট বিতরণ করলেও নির্বাচন ঘিরে কঠোর কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা তা এখন পর্যন্ত পরিস্কার নয়। তবে পরিকল্পনা থাকলেও সুসজ্জিত এই প্রশাসনের সামনে তারা টিকতে পারবে এমনটা অধিকাংশ মানুষই মনে করছে না। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে এবার প্রশাসনের অবস্থান বেশ দৃঢ় বলে মনে হলেও যদি দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্ত কিংবা কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের দ্বারা কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সুত্রপাত হয়েই যায়, তবে প্রশাসন তা কিভাবে মোকাবেলা করবে তা নিয়েও জনমনে বেশ কৌতুহল রয়েছে।
৩. জোরাজুরির আশঙ্কা, নেতাকর্মীদের বেফাঁস মন্তব্য
কিন্তু এমন পরিস্থিতির মাঝেও সব প্রার্থীদের মধ্যে একটা দিক থেকে মিল রয়েছে। তা হলো দলীয় হোক বা স্বতন্ত্র হোক, সবাই সাধারণ জনগনকে এবার ভোট দিতে যাওয়ার জন্য জোড়ালোভাবে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। কিন্তু সংঘাতের আশঙ্কায় সাধারণ মানুষের একটা অংশ ভোটে নিরুৎসাহিত হলেও, ক্ষমতাসীন দল যে এবার কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি দেখাতে চায়, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন ও সমমনা দলগুলোর নেতাকর্মীদের জোড়ালো আমন্ত্রণ, সরকারী সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠীকে ভোট দেয়া বাধ্য-বাধকতা নিয়ে উচ্চ আদালতের রীট, কিছু কিছু স্থানে বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা সুবিধাভোগীদের কার্ড জমা নেয়া, আনসার পরিবারের সদস্যদের জন্য বাধ্যতামূলক ভোট দেয়ার নির্দেশনার অভিযোগ নিয়ে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন গনমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এসব ঘটনা প্রত্যক্ষ করে অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে, ভোটারদের অনিচ্ছা থাকলেও ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসতে এবার জোরাজুরি করা হতে পারে। বিগত দিনগুলোতে সারাদেশে ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাকর্মীরা বেশ কিছু বেফাঁস মন্তব্য করেছেন। জনগন তা নিয়ে কেবল হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও নির্বাচন পূর্ববর্তী মুহূর্তে কিছু নেতাকর্মীদের বেফাঁস মন্তব্য জনগনকে আরও গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলছে। ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে না ও হবে না, বরং উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে বলে ক্ষমতাসীন দল ও নির্বাচন কমিশনের উপর মহল থেকে বার্তা দেয়া হচ্ছে। এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলেও আশ্বস্ত করা হচ্ছে।
ভোট দেয়া যেমন ভোটারদের অধিকার, তেমনি কোনো ভোটারকে ভোট দিতে বাধা দেয়া বা ভোট দিতে বাধ্য করাও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে ভোট দিতে অনিচ্ছুক ভোটারদের এই মানবাধিকার নির্বাচনের মুহূর্তে কতটুকু রক্ষিত থাকবে তা নিয়ে জনগণের বড় একটা অংশ এখন পর্যন্ত সন্দিহান।
৪. ভোট দেয়ার অনীহা ও হতাশা
২০১১ সালের ১০ মে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় দেয়। এছাড়াও সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বাতিল করা হয়। এরপর অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন যে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। এরপর বিগত ২০১৪ ও ২০১৮ সালের দুটি নির্বাচন নিয়ে জনগন ও আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক সমালোচনা হয়। “আপনার ভোট দেয়া হয়ে গেছে, বাড়ি চলে যান” এমন শিরোনামে বিভিন্ন গনমাধ্যমে সংবাদও প্রকাশিত হয়। এছাড়াও নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তির অভিযোগ এবং এ নিয়ে জাপানের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন দল ও তৎকালীন নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্যসমূহ, প্রবল বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও নির্বাচনে ইভিএম নিয়ে নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম, ৫৭ সেকেন্ডে ৪৩ ভোটের ভিডিও, নির্বাচনের দিন অন্যান্য প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া, প্রার্থীদের উপর হামলা করা, নেতাকর্মীদের বেফাঁস মন্তব্য জনগণের মনে আরও হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দেয়। এসব ঘটনা জনগণের মাঝে ভোটের প্রতি যে অনীহার জন্ম দিয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এবারের নির্বাচনের মাঠে কার্যত কোনো বিরোধী দল না থাকায় তা আরও ঘনীভূত হয়েছে। জনগণের মাঝে একটা ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে ভোট যাকেই দেয়া হোক, ফলাফল একই। ভোটের মাধ্যমে এ নির্বাচনে সরকার পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই। যা ভোটারদের ভোট দেয়ার অনীহাকে আরও তীব্রতর করেছে। এরমধ্যে ভোট দিতে যাওয়ার জোড়ালো আমন্ত্রণ অনেকেই ভালোভাবে নিচ্ছেন না। অনেকেই এমন প্রশ্নও ছুড়ছেন যে আগে তো ভোটারদের ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল, এখন কেন আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে?
৫. অনিশ্চয়তা ও উৎকণ্ঠা
বিগত দুটি নির্বাচন যেমন তেমন ভাবে হয়ে গেলেও এবারের নির্বাচনটি যে আগের মত হবে না, এমনটা মোটামুটি সবাই আগে থেকেই ধারণা করেছিলেন। এমনকি ক্ষমতাসীন দলও সেটা বিবেচনায় রেখেই আগাতে থাকে। কারন এবার বিএনপি ও সমমনা দলগুলো ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনড়। কিন্তু সরকার তা আমলে না নিয়ে দমন পীড়ন অব্যাহত রেখেছে। এবারের নির্বাচন ঘিরে আন্তর্জাতিক মহলের কৌতুহল ও তৎপরতাও বেশ লক্ষণীয়। বিভিন্ন ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দেয়াসহ বারবার একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত, পশ্চিমা বিশ্ব, চীন ও রাশিয়া বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যার যার অবস্থান জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই সুষ্ঠু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সিনেটরদের চিঠিতে নিষেধাজ্ঞার আহ্বান, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শ্রমনীতি সহ নানা ঘটনায় জনমনে এই ধারণা জন্মেছে যে এবারের নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে হয়তো দেশের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আসবে। নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে আন্তর্জাতিক বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য, নির্বাচনের পর নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে বলে ক্ষমতাসীন দলের উপর মহল থেকে পূর্বাভাস এবং দুর্ভিক্ষ আসতে পারে বলে খোদ প্রধানমন্ত্রীর পূর্বাভাস এসব কিছুই সাধারণ জনগণের উৎকণ্ঠাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাবলীর প্রভাব দেশের অর্থনীতির উপর পড়েছে। দেশের রিজার্ভও খুব একটা ভালো অবস্থানে নেই। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী। এরমধ্যে যদি কোনপ্রকার নিষেধাজ্ঞা এসেই যায়, তবে তা মোকাবেলা করার মতো সক্ষমতা কতটুকু সেটিও এক বড় প্রশ্ন। তার উপর রাজনৈতিক দলগুলোর মতানৈক্য দেশকে আরও গভীর অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর এক চুড়ান্ত মতৈক্যে পৌঁছানো। হয়তোবা সেটাও কোনো একসময় হবে। কিন্তু ততক্ষণে দেশের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। সাধারণ মানুষ এখনই তাদের সঞ্চয় ভেঙে কোনোরকমে খেয়ে পড়ে জীবন যাপন করছে। এর মধ্যে কোনো নিষেধাজ্ঞা আসলে রাজনৈতিক দলের পদধারী নেতা, বড় বড় ব্যবসায়ী ও সরকারী চাকুরীজীবিদের হয়তো খুব বেশি একটা কষ্ট হবেনা। কিন্তু সাধারণ মানুষের উপর নেমে আসবে সীমাহীন দুর্ভোগ।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রতিবার নির্বাচনের পরই নির্বাচিত দলের প্রতি জনগণের হতাশা ও ক্ষোভ বেড়েছে। আর জনগনকে বারবার কেবল মন্দের ভালোটিকেই বেছে নিতে হয়েছে। যে দলই ক্ষমতায় আসে, সেই দলের কাছেই জনগন অবহেলিত থেকে যায়। দিনশেষে সব রাজনৈতিক দলই জিতে যায়। হেরে যায় কেবল জনগন।