Close

আলোর বেগে ছুটে চললে আমরা কী কী দেখতে পাবো? (পর্ব-১)

What would we see at the speed of light Part 01

What would we see at the speed of light Part 01

ধরা যাক, আমরা এমন এক মহাকাশযানে আছি, যা পৃথিবী থেকে মহাশূন্যের দিকে যাত্রা শুরু করেছে, আর তার সাথে এর গতিও ক্রমশ বেড়েই চলছে। আমরা যদি এর গতি কেবল বাড়াতেই থাকি, কি দেখতে পাবো? কি কি আলোকীয় ঘটনা আমাদের চোখে পড়বে? আর যদি আমরা সাইফাই মুভির মতো স্পেসটাইম বেন্ড করে আমাদের মহাকাশযানের গতি অনেক অনেক বাড়িয়ে আলোর গতির কাছাকাছি বা তার চেয়েও বেশি গতিতে চলার চেষ্টা করি, সেক্ষেত্রে কি দেখতে পাবো?

এই প্রশ্নগুলির উত্তর আমাদের মহাবিশ্বের অনেক আকর্ষণীয় ফেনোমেনন সম্পর্কে জানতে এবং জেনারেল ও স্পেশাল রিলেটিভিটি সম্পর্কে গভীর ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন করতে সহায়তা করবে।

আমাদের মহাকাশযানটি প্রথমে স্থির অবস্থায় থাকে। একবার উৎক্ষেপণ করার পর, এটি ত্বরান্বিত হতে শুরু করে । যদিও প্রতিটি যানের ক্ষেত্রে গতির একটি সীমা থাকে, তথাপি বোঝার সুবিধার্থে আমরা ধরে নিচ্ছি যে, এর যান্ত্রিক ব্যবস্থা আমাদের যতক্ষণ ইচ্ছা, ততক্ষণই ত্বরান্বিত করতে দেয়। যত দ্রুত গতিতে আমরা ভ্রমন করি, ততই পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাই। কেউ কেউ হয়তো ভাবতে পারেন যে গতি অত্যাধিক পরিমাণে বাড়াতে থাকলে একপর্যায়ে তা অসহনীয় হয়ে উঠবে। তবে ঘটনাটি কিন্তু এমন নয়। আসলে গতি আমাদের শরীরের উপর কোনরকম প্রভাব ফেলে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যখন দুটি ট্রেন পাশাপাশি অতিক্রম করে, তখন আমাদের ট্রেন, নাকি অন্যটি স্থির অবস্থায় আছে তা বোঝা প্রায় অসম্ভব। এছাড়াও পৃথিবির আহ্নিক গতি বা বার্ষিক গতিও কিন্তু আমরা অনুভব করতে পারি না। একইভাবে মহাকাশযানের ভিতরেও আমরা এর গতি অনুভব করতে পারবো না। তবে এর ত্বরণ, বা ইঞ্জিনের ধাক্কাটাই কেবল অনুভব করতে পারবো যা আমাদের উপর সিটের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করে। যদি এই ধাক্কা সহনীয় পর্যায়ের হয়, তাহলে মহাকাশযানের গতিও আমাদের পুরো যাত্রা জুড়েই সহনীয় হবে। এমনকি তা আলোর গতিতে চললেও।

তবে খুব বেশি গতিতে সংঘর্ষের ঝুঁকিও রয়েছে। অতি উচ্চগতিতে সামান্য একটি ডাস্ট কণার আঘাতেও আমাদের মহাকাশযান চুর্নবিচুর্ন হয়ে যেতে পারে। তাই আমরা আরও ধরে নিচ্ছি যে, আমাদের মহাকাশযানটি এমন একটি ফোর্সফিল্ড দিয়ে সুসজ্জিত, যা সব বিপজ্জনক বস্তুগুলিকে প্রতিহত করে দূরে সরিয়ে দেয়। আর আমাদেরকে মহাকাশে যত গতিতে খুশী, অবাধে চলাচল করতে সাহায্য করে।

আলোর বিচ্যুতি (The Aberration of Light)

মহাকাশযানের গতি বাড়াতে থাকলে সর্বপ্রথম যে আলোকীয় ঘটনাটি আমাদের চোখে পড়বে, সেটি হলো যদিও আমরা সামনের তারাগুলোর দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু তারপরও আমরা দেখতে পাবো যে তারাগুলো ধীরে ধীরে আমাদের থেকে আরও দূরে সরে যাচ্ছে। মনে হবে যে মহাকাশে আমাদের সামনের অংশ ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। এই ঘটনাটি বুঝতে হলে, একটি সাধারণ পরিস্থিতি ভাবুন যেখানে আপনি একটি গাড়িতে আছেন যা দ্রুত গতিতে চলছে। এবং এর মধ্যে বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টি উপর থেকে নীচে উল্লম্বভাবে পড়ে। কিন্তু গাড়িটি যখন সামনের এগিয়ে যায়, তখন আপনি উইন্ডশিল্ডে সামনের দিক থেকে বৃষ্টির ফোঁটা পান। আপনার কাছে মনে হবে যে বৃষ্টি উপর থেকে পড়ছে না। বরং সামনে থেকে পড়ছে যেন এর গতিপথ তীর্যক। এবং আপনি যত বেশি গতি বাড়ান, ততই সামনের দিক থেকে প্রায় আনুভুমিকভাবে বৃষ্টির ফোঁটা আসে। আমাদের মহাকাশযানে আলোকীয় ঘটনাও পুরোপুরি অনুরূপ। তারার আলো একটি নির্দিষ্ট দিক থেকে আসে। কিন্তু আমরা যখন ত্বরান্বিত হই, তখন আলোকরশ্মি সামনের দিক থেকে আরও বেশি করে আসতে দেখা যায়। আমরা যখন গতিশীল থাকি তখন তাদের দিক ভিন্ন বলে মনে হয়। এই ঘটনাকে বলা হয় “আলোর বিচ্যুতি” (The Aberration of Light)।

টেরেল পেনরোজ রোটেশন (Terell Penrose Rotation)

আলো যখন আমাদের সামনে কেন্দ্রীভূত হয়, তখন এর তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। আমাদের পিছনের দিকে আকাশ আরও প্রশস্ত এবং অন্ধকার হয়ে ওঠে। আলোর বিচ্যুতির ফলে আরেকটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। মনে করুন আমরা মহাকাশের স্ট্রাকচারের একটি বিশাল গ্রিডের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। সাধারণত আমরা দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আমাদের সামনে সরলরেখা দিয়ে তৈরি একটি সোজা গ্রিড দেখতে পাব।

তবে গতি বাড়ার ফলে, বিচ্যুতির ঘটনাটি আমাদের চারপাশের আকাশের চিত্রকে বিকৃত করে। দিন যত যায় গ্রিডটি সামনের দিকে সঙ্কুচিত হতে থাকে। এবং সরলরেখাগুলি বাঁকতে থাকে। আমরা যদি কোনও বস্তুর পাশ দিয়ে যাই তবে এটি আমাদের দিকে সামান্য বাঁকানো বলে মনে হবে। এটিকে টেরেল পেনরোজ রোটেশন বলা হয়। আমরা যখন খুব দ্রুত অগ্রসর হই, তখন বস্তুর চিত্রগুলি আমাদের সামনে সঙ্কুচিত বলে মনে হয় এবং পারস্পেকটিভ তীব্রভাবে বিকৃত হয়।

ডপলার ইফেক্ট (The Doppler Effect)

আমরা প্রায়ই শুনি যে, আমরা মহাকাশে যতই দূরে তাকাই, ততই অতীতের দিকে তাকাই। প্রকৃতপক্ষে, দূরবর্তী একটি নক্ষত্র থেকে আমরা যে আলোটি পাই, তা কোটি কোটি কিলোমিটার ভ্রমণ করে আসে। এই যাত্রা কিন্তু তাৎক্ষণিক নয়। বরং আলো আমাদের কাছে পৌঁছাতে সময় লাগে। ফলস্বরূপ, আমরা নক্ষত্রটিকে সেই আগের মতোই দেখতে পাই, যখন এটি সেই আলো নির্গত করত। হয়তো কয়েক হাজার বছর আগে। আর আমরা হয়তো জানিনা তখন থেকে এটি কতটা পরিবর্তিত হয়েছে। আমাদের মহাকাশযান থেকে তাকালে একই ঘটনা কাজ করে। 

আমরা পৃথিবী থেকে দূরে সরে গেলে, গ্রহের আলো আমাদের কাছে পৌঁছাতে আরও বেশি সময় নেয়। যদি আমরা টেলিস্কোপ দিয়ে জুম করে দেখতে পারতাম, তাহলে আমরা পৃথিবীতে মানুষ ধীর গতিতে বিবর্তিত হতে দেখতাম। এটি ডপলার ইফেক্ট। পৃথিবীর প্রতিটি ঘড়ির টিক টিক আমাদের কাছে পৌঁছাতে আরও বেশি সময় নেয়। আমরা ধীর গতিতে আলোক রশ্মি গ্রহণ করি এবং গ্রহের আলো লাল রঙের দিকে সরে যাওয়ার সাথে সাথে তাদের তীব্রতা দুর্বল হয়ে পড়ে। আর আমাদের সামনের দিকে ঘটে তার ঠিক বিপরীত ইফেক্ট। তারাগুলো থেকে মহাকাশযানটির সামনের দিকে আলো আরও দ্রুত এসে পড়ে বিধায় তারাগুলি আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বলে মনে হয়। আর তাদের বর্ণ নীল রঙের দিকে সরে যায়। এবং তাদের ঘড়িগুলি দ্রুত টিক টিক করে। সুনির্দিষ্ট সরঞ্জামের সাহায্যে, আমরা মহাকাশে আমাদের ত্বরণের শুরু থেকে বিচ্যুতি এবং ডপলার ইফেক্টের পরিমাপ করতে পারি।

তবে যদি আমরা আমাদের যাত্রা শেষ করে পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই, তাহলে এই ইফেক্টগুলির কোনও প্রভাব থাকবে না। গতিশীল অবস্থায় আলো যেভাবে আমাদের কাছে আসে, এগুলো তার কারণে ঘটা আলোকীয় ঘটনা বা দৃষ্টিভ্রম।

গতি আরও বাড়ালে কি ঘটবে তা ২য় পর্বে ব্যাখ্যা করবো। আর ২য় পর্ব নিয়ে খুব শীঘ্রই ফিরে আসছি।

(সুত্রঃ সাইন্সক্লিক)

প্রযুক্তিবিদ ও সমাজকর্মী

2 Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

2 Comments
scroll to top