পূর্ববর্তী পোস্টে আমরা জেনেছি আমাদের কাল্পনিক মহাকাশযানের গতি ক্রমশ বাড়াতে থাকলে কি কি আলোকীয় ঘটনা আমরা দেখতে পাই। তবে এই গতি আলোর গতির তুলনায় অনেক কম। এমনকি কাছাকাছিও নয়। আজ আমরা জানবো যে আমাদের গতি বাড়াতে বাড়াতে আলোর গতিতে চললে আমরা কি কি দেখতে পাবো? আপনি যদি প্রথম পোস্টটি না পড়ে থাকেন, তাহলে নিচের লিংক থেকে সেটা পড়ে নিতে পারেন।
আরও গতি বৃদ্ধি ও বিশেষ আপেক্ষিকতা (Increasing The Speed & Special Relativity)
অনেকদিন ধরে যদি আমরা মহাকাশযানের গতি কেবল বাড়াতেই থাকি, তবে একসময় হয়তো মহাকাশযানটি আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে চলতে শুরু করে। এই গতিতে কিছু ঘটনা আর শুধু আলোকীয় ঘটনা বা দৃষ্টিভ্রম হিসেবে থাকবে না। বরং অপরিবর্তনীয় কিছু বাস্তব ভৌত প্রভাব পড়তে শুরু করবে। এক্ষেত্রে বিশেষ আপেক্ষিকতা (Special Relativity) কার্যকর হবে।
সময়ের প্রসারণ (Time Dilation)
বিশেষ আপেক্ষিকতার প্রথম পরিণতি হল সময়ের প্রসারণ। আমাদের মহাবিশ্ব হল একটি বিশাল চার-মাত্রিক কাঠামো যা স্থানের তিন মাত্রা (দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা/গভীরতা) এবং সময়ের এক মাত্রা দিয়ে গঠিত। স্পেসটাইমের ভিতরে, সমস্ত বস্তু একটি গতিপথ অনুসরণ করে। কারণ তারা সকলেই তাদের ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হয়। উড্ডয়নের আগে, আমাদের মহাকাশযান পৃথিবীর মতোই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু গতি বাড়ানোর সফলে এবং পৃথিবী থেকে অতিদ্রুত দূরে সরে যাওয়ার ফলে ভবিষ্যতের অভিমুখে আমাদের গতিপথ ধীরে ধীরে গ্রহের গতিপথ থেকে বিচ্যুত হয়। আমাদের সময়ের অক্ষ/মাত্রা আর পৃথিবীর মানুষের সময় অক্ষের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে না। আমরা যদি ঘুরে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিই, তাহলে আমাদের ঘড়িগুলি পৃথিবীর ঘরিগুলো থেকে একটি ভিন্ন সময় পরিমাপ করবে। এবং আমরা পৃথিবীর মানুষের চেয়ে কম বয়সী হবো। কারণ স্পেসটাইমে আমাদের গতিপথ ভিন্ন ছিলো।
দৈর্ঘ্য সংকোচন (Length Contraction)
বিশেষ আপেক্ষিকতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিণতি হল দৈর্ঘ্য-সংকোচন। যখন কোনও বস্তু আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে চলে, তখন দৈর্ঘ্য তার গতির অভিমুখে সংকুচিত হয়। মহাকাশযানের দৃষ্টিকোণ থেকে, সমগ্র মহাবিশ্ব পিছনের দিকে চলছে। ফলে আমাদের কাছে মহাবিশ্ব আমাদের গতির দিকে সংকুচিত হবে। ফলে আমাদের গন্তব্যের দুরত্ব প্রত্যাশিত দুরত্বের চেয়ে কম হবে। এটা কোন আলোকীয় ঘটনা নয়, বরং একটি বাস্তব ভৌত ঘটনা। যদি আমরা কোনও দূরবর্তী নক্ষত্রে যাওয়ার চেষ্টা করি, তাহলে যাত্রাটি আমাদের কাছে সত্যিই সংক্ষিপ্ত মনে হবে। অর্থাৎ, আমরা যত দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাব, সময় ততই কম লাগবে।
সুতরাং প্রচলিত ভুল ধারণার বিপরীতে বলা যায়, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই হাজার হাজার আলোকবর্ষ ভ্রমণ করা সম্ভব। আর যদি আমরা প্রায় আলোর গতিতে এগিয়ে যাই, তাহলে যাত্রাটি আমাদের কাছে অনেকটাই তাৎক্ষণিক মনে হবে। তবে পৃথিবীর মানুষের কাছে তা কয়েক হাজার বছর ধরে অতিবাহিত হবে। দৈর্ঘ্য সংকোচন একটি বাস্তব ঘটনা। তবে দৃশ্যত এটি দেখা কঠিন। কেন তা বোঝার জন্য কল্পনা করুন, যে আমরা একটি গ্রহের কক্ষপথ অতিক্রম করছি। এটি আমাদের দিকে খুব দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে গ্রহটির দৈর্ঘ্য সংকুচিত হয়। কিন্তু মনে আছে? মহাকাশে আমরা যত দূরে তাকাই, ততই আমরা অতীতের দিকে তাকাই। এবং আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে, গ্রহের পিছনের অংশটি গ্রহের সামনের অংশের চেয়ে মহাকাশে আরও দূরে অবস্থিত। গ্রহের পিছনের অংশ থেকে আমরা যে চিত্র পাই তা আমাদের কাছে পৌঁছাতে বেশি সময় নেয়। তাই আমরা এটিকে অতীতের মতো দেখতে পাই, এমনকি যদিও এটি সংকুচিত হয়। গ্রহটি দেখতে তেমন দেখা যায় না কারণ আমরা এর পিছনের অংশের চিত্র বিলম্বে পাই। সংকুচিত হওয়ার পরিবর্তে, এটি তীর্যক বলে মনে হবে। এটি এমন একটি ঘটনা যা সম্পর্কে আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি। মানে টেরেল পেনরোজ রোটেশন।
যখন আমরা খুব দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাই এবং পাশের দিকে তাকাই, তখন আমাদের চারপাশের বস্তুর প্রান্তগুলি গতির দিকে ছোট বলে মনে হয়। এটিকে দৈর্ঘ্য সংকোচন হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। আবার ঘোরানো মনে হয় বলে একে ঘূর্ণন হিসেবেও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
একই কারণে পারস্পেকটিভ পরিবর্তনের ফলে, আমাদেরকে দেখছেন এমন একজন ব্যক্তি আসলে আমাদের মহাকাশযানটিকে সঙ্কুচিত দেখতে পাবেন না। বরং ঈষৎ ঘোরানো অবস্থায় দেখবেন। গতি বাড়াতে থাকলে সময়ের সাথে সাথে আমাদের ফিল্ড অফ ভিউ সংকুচিত হতে থাকে। আর তা সামনের দিকে তীব্র উজ্জ্বল হয় আর পিছনের দিকে সম্পূর্ণ কালো হয়ে যায়।
গতি বাড়াতে বাড়াতে আমরা হয়তো কোনো এক সময় আলোর গতিতে পৌঁছানোর আশা করতে পারি। তখন আমরা কী দেখতে পাব? এই প্রশ্নটি আপেক্ষিকতার মৌলিক প্রশ্নগুলির মধ্যে একটি। উত্তর হল “না”। মহাকাশযানটি ক্রমাগত ত্বরান্বিত হলেও আমরা কখনই আলোর গতিতে পৌঁছাতে পারবো না। কারণ আলোর গতি পরম। আপনি একটি আলোর রশ্মি ধরার চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু আপনার ফিল্ড অফ ভিউ থেকে, এটি সর্বদা একই গতিতে দূরে সরে যাবে। ঠিক আলোর গতিতেই। আপনি যতটা ইচ্ছা ত্বরান্বিত হতে পারেন। এমনকি পৃথিবীর সাপেক্ষেও যদি আপনি আলোর গতির কাছাকাছি পৌঁছান, আপনার ফিল্ড অফ ভিউ থেকে, আপনাকে গতিহীনই মনে হবে। এবং আলো সবসময়ই একই গতিতে আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যাবে।
সংক্ষেপে, আলোর গতি অতিক্রম করা, এমনকি তার কাছাকাছি গতিতে চলাও একেবারেই অসম্ভব। সর্বোপরি, আমাদের মহাকাশযান চিরকাল ত্বরান্বিত হতে থাকবে। এবং আমাদের ফিল্ড অফ ভিউ আরও সঙ্কুচিত হতে থাকবে। যতক্ষণ না আমাদের সামনে একটি অসীম উজ্জ্বল বিন্দু তৈরি হবে, যা সম্পূর্ণ কালো আকাশ দ্বারা বেষ্টিত।
আলোর গতিতে, সমস্ত অপটিক্যাল প্রভাব চরমে উন্নিত হবে। চলন্ত অবস্থায় মনে হবে সব আলোক রশ্মি আমাদের সামনে আলোক রশ্মি চারদিক থেকে না এসে কেবল সামনে থেকেই আসছে এবং আমাদের পিছনের আলোক রশ্মি কখনই আমাদের কাছে পৌঁছাতে পারবে না। আমাদের রেফারেন্সের কাঠামোতে মহাবিশ্ব অত্যন্ত সংকুচিত হবে। একটি পাতলা কাপড়ের মতো যা আমরা এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশে এক পাশ থেকে অন্য পাশে অতিক্রম করব। পৃথিবীতে অবস্থান করা একজন ব্যক্তির সাপেক্ষে আমরা আলোর গতিতে চলব। কিন্তু আমাদের জন্য এই যাত্রা তাৎক্ষণিক বলে মনে হবে। আমরা অসীম দ্রুত গতিতে চলমান থাকবো।
ওয়ার্প ডাইভ (WARP DIVE)
সংক্ষেপে বলতে গেলে, মহাকাশে আলোর চেয়ে দ্রুত গতিতে আর কিছুই চলতে পারে না। কিন্তু এই সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে যাওয়ার হয়তো কোনো উপায় থাকতে পারে। আসলে, কোনোকিছুই মহাকাশে আলোর চেয়ে দ্রুত গতিতে চলতে আমাদের বাঁধা দেয় না। প্রকৃতপক্ষে, সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব আমাদের শেখায় যে স্পেসটাইমের কাঠামোটি ডাইনামিক। এটি বিভিন্ন উপায়ে বেন্ড করা (বাঁকানো) যেতে পারে। ফলে আমরা আমাদের মহাকাশযানের চারপাশে একটি বুদবুদ তৈরি করার কল্পনা করতে পারি যা দিয়ে আমরা আলোর চেয়ে দ্রুত গতিতে চলবো। এটিকে ওয়ার্প ড্রাইভ বলা হয়। বিজ্ঞানের কল্পকাহিনীর ভাষায়, এটি আর মহাকাশের মধ্য দিয়ে কোনও যানবাহনকে কেবল জুম করার মতো বিষয় হবে না। কিন্তু স্পেসটাইমের কাঠামোকে চালিত করে, আমাদের মহাকাশযান আলোর চেয়ে দ্রুত গতিতে তরঙ্গের উপর স্থির থাকবে।
এই মুহূর্তে এই ধরণের কাঠামো অযৌক্তিক মনে হবে। কেননা বর্তমানে এটি অর্জন করা অসম্ভব। কারন একটি ওয়ার্প ড্রাইভ তৈরি করতে হলে স্পেসটাইমকে বিপুল পরিমাণে ঋণাত্মক ভর দিয়ে বাঁকানো প্রয়োজন যার কোন অস্তিত্ব আমাদের মহাবিশ্বে এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে, এরপরও গণিত আমাদের মডেল করা এবং গণনা করার মাধ্যমে অনেক কিছুই ভাবতে সহায়তা করে। তাই, এই পরিস্থিতিতে আমরা কী দেখতে পাব? যদি আমরা ওয়ার্প ড্রাইভকে বাইরে দিকে দেখি। মনে হবে হঠাৎ একজায়গা থেকে লেন্সের আকৃতবিশিষ্ট একটি বুদবুদ দুই ভাগ হয়ে দুইদিকে সরে যাচ্ছে। একটি অংশ সামনের দিকে এবং অন্যটি পেছনের দিকে।
যেহেতু আলো ওয়ার্প ড্রাইভের চেয়েও ধীর গতিতে চলে। তাই যখন এটি কাছে আসে, আলো তখনও আমাদের কাছে পৌঁছায় না। এবং এটি আমাদের অতিক্রম করে চলে যাওয়ার পরে আমরা সেই পূর্বের এবং পরের আলোক রশ্মি একসাথে গ্রহন করি। ওয়ার্প ড্রাইভের ভিতর থেকে তাকালে আমরা দেখতে পাব যে আকাশ আমাদের সামনে সঙ্কুচিত এবং পিছনে খুব উজ্জ্বল। মহাবিশ্ব অত্যন্ত অন্ধকার দেখাবে। এবং আকাশের একটি সম্পূর্ণ অংশ স্থায়ীভাবে আমাদের দৃষ্টির বাইরে চলে যাবে। কারন সেখান থেকে নির্গত আলো আমাদের কাছে পৌঁছাতে পারেনা। আমাদের ফিল্ড অফ ভিউ থেকে মহাবিশ্বের একটি কোণ স্থায়ীভাবে অদৃশ্যই থেকে যায়।
(সুত্রঃ সাইন্সক্লিক)