লেখিকা: জেরিন জাহান দিশা
আমার আব্বু মোঃ আনিছুর রহমান—একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, যার হাত ধরে গড়ে উঠেছে অসাধারণ এক জীবনগল্প। আমার দাদার নাম ছহিরউদ্দিন বিশ্বাস। তিনি ছিলেন চাটাই ব্যবসায়ী, আর সংসারে ছিল ছয় ছেলে ও তিন মেয়ে। দারিদ্র্য ছিল পরিবারে নিত্যসঙ্গী। ছোটবেলা থেকেই আব্বু ছাগল-ভেড়া চরানো, মাঠে ছিট দিয়ে জামাকাপড় বানানো, এমনকি ঢেঁকি ছাঁটাইয়ের মতো কঠিন কাজেও হাত লাগাতেন।
একদিন গ্রামের এক ব্যক্তি দাদাকে বললেন, “আপনার ছেলে তো দর্জির কাজ শিখলে ভালো পারবে।” সেখান থেকেই শুরু হয় আব্বুর কারিগরি যাত্রা। স্থানীয় এক আত্মীয়ের বাড়িতে কাজ শেখা শুরু করেন, পরে মুজিবর নামের এক ভদ্রলোক তাঁকে বাজারের নামী দর্জি আতিয়ার রহমানের দোকানে নিয়ে যান। খুব দ্রুত আব্বুর নিখুঁত কাজ সবাইকে মুগ্ধ করে।
এসএসসি পাশ করে আব্বু নিজ বাড়িতে একটি সেলাই মেশিন কিনে দোকান দেন। নিষ্ঠা, ধৈর্য ও কারিগরি দক্ষতায় অল্প সময়ে এলাকার প্রিয় মানুষ হয়ে ওঠেন। এই সময়েই জীবনের বড় মোড় আসে। আমার দাদি ধান শুকাতে গিয়ে পড়ে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন, দীর্ঘদিন চিকিৎসা করেও কোনো উন্নতি হয়নি। এক আত্মীয়ের পরামর্শে আব্বু তাঁকে ঝিনাইদহের হোমিও চিকিৎসক আলাউদ্দিন সাহেবের কাছে নিয়ে যান। আশ্চর্যজনকভাবে দাদি সুস্থ হয়ে ওঠেন।
এখান থেকেই আব্বুর মনে জাগে নতুন ইচ্ছা—নিজেই হোমিও ডাক্তার হবেন, যাতে পরিবারের এবং এলাকার মানুষকে সেবা দিতে পারেন। গ্রামের হোমিও চিকিৎসক হাসিবুল ডাক্তারের কাছ থেকে পরামর্শ নেন। আমার মা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন গাংনীর গোপালনগরে মাহফুজুর রহমান সেন্টুর অধীনে L.H.M.P কোর্স হচ্ছে। মায়ের উৎসাহে আব্বু ভর্তি হন।
প্রতি শুক্রবার ক্লাস, ওষুধের নাম খাতায় লেখা, পড়াশোনা—সব কিছু খুব নিষ্ঠার সাথে করতেন। কোর্স শেষ করে নিজের বাড়িতে ছোট্ট চেম্বার দেন। দর্জির খরিদ্দারদের মাধ্যমে খবর ছড়াতে থাকেন। ফলে টিউমার, বন্ধ্যাত্ব, কিডনির পাথরের মতো জটিল রোগে মানুষ সুস্থ হতে শুরু করে। পরে কুষ্টিয়া থেকে D.H.M.S কোর্সেও ভর্তি হন, তবে অসুস্থতার কারণে শেষ করতে পারেননি।
আমার আব্বুকে নিয়ে আমরা সবাই গর্ব করি। দূর-দূরান্ত থেকে রোগী আসে তাঁর কাছে। এই চিকিৎসার মাধ্যমেই তিনি আমাদের জন্য একটি সুন্দর ছাদের বাড়ি তৈরি করেছেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁর বাবা, আমার দাদা সেই বাড়ি দেখে যেতে পারেননি।
একদিন সকালে মাঠে কাজ করতে গিয়ে হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভব করেন দাদা। আব্বু তাঁর প্রেসার মেপে ওষুধ দেন। কিছুক্ষণ ভালো থাকলেও বিকেলে দাদার অবস্থা খারাপ হয়। মা সুজি খাইয়ে দিতে গেলে দাদা বলেন, “আমি নিজে খেতে চাই।” সেই মুহূর্তে তিনি আব্বুর হাত ধরে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। এই শোক আব্বুকে মানসিকভাবে ভেঙে দেয়। পরবর্তীতে তাঁর নিজের হার্টেও সমস্যা দেখা দেয়।
দাদার মৃত্যুর পর দাদীর শারীরিক অবস্থাও খারাপ হয়ে যায়। হঠাৎ একদিন প্রেসার বেড়ে স্ট্রোক করেন এবং এক বছর বিছানায় কাটে। আব্বুর মহান গুণ ছিল—তিনি দিনে যতবার খাওয়ার সময় হতো, ততবার জিজ্ঞেস করতেন, “মা খেয়েছো?” দাদি বলতেন, “হ্যাঁ, খেয়েছি।” সারারাত দাদি কাউকে ঘুমাতে দিতেন না, তখন আব্বু তাঁকে পাহারা দিতেন—আমিও অনেক রাত জেগে ছিলাম আব্বুর সঙ্গে।
আমার দাদি সুস্থ থাকতে কখনো গরুর মাংস বা ডিম ছুঁতেন না। শুধু কবুতরের মাংস দিয়ে ভাত খেতেন। কিন্তু অসুস্থ হওয়ার পর তিনি সবই খেতেন। ২১ জুলাই ২০২৩ সালে দাদি মারা যান। সেদিন সকালে তাঁর প্রেসার লো ছিল, গায়ে যম ফোস্কা দেখা গিয়েছিল। মা ও আমি তাঁকে গোসল করানো, খাওয়ানো—সবই করতাম। রাতে প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। আব্বু অসুস্থ থাকায় দাফনে মাটি দিতে যেতে পারেননি। দাদি সবসময় বলতেন, “আমি মারা গেলে আমার ছেলে পাগল হয়ে যাবে। কাকে মা বলে ডাকবে?”