জোনাকী দত্ত
আরে মানিক না? গাছ তলায় বসে কি করছিস? ছাতাটা বন্ধ করে প্রধান শিক্ষক এগিয়ে এসে বলল মানিককে। স্যারকে দেখে মানিক ততমত হয়ে গেল। নমস্কার জানিয়ে বলল, না স্যার, এমনি বসে আছি। স্যার বলল, তোকে তো গত কয়েকদিন ধরে স্কুলে দেখছি না। অসুস্থ নাকি? মানিক মাথা চুলকিয়ে বলল, না স্যার, আমি ভালো আছি। আমার আর স্কুলে যেতে ইচ্ছে করছে না। তাই এখানে এসে বসে থাকি। অবাক হয়ে স্যার ওর পাশে বসে বলল, কেন রে? কেউ তোকে কিছু বলেছে? নাকি তোর মা পড়াতে পারছে না। কিন্তু তোকে তো হাফ বেতনে আমরা ভর্তি করিয়েছি, কি সমস্যা হলো তাহলে। মানিক বলল, না স্যার কোন সমস্যা হচ্ছে না। আর মা জানেনা আমি স্কুলে যাচ্ছি না। মা তো সেই সকালে গার্মেন্টসে চলে যায়, আসে সন্ধ্যায়। তার কথা যত শুনছে প্রধান শিক্ষক ততই অবাক হয়ে যাচ্ছে।
তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, আমাকে বলতো মানিক কি হয়েছে? সামনে প্রথম সাময়িক পরীক্ষার রেজাল্ট দেবে। এখন তো সব ক্লাসে পরীক্ষার খাতা দেখানো হচ্ছে। আর এই সময় তুই স্কুল বন্ধ করে দিলি? মানিকের চোখে জল। সে বড় অভিমানী ছেলে। তার বাবা নেই। মা একটা ছোট বাসায় তাকে নিয়ে থাকে। গার্মেন্টসে চাকরি করে কোন রকমে দুজনের চলে যায়। কিন্তু মানিককে কোন গৃহশিক্ষক দিতে পারেনি। তাই ক্লাসের সব পড়া সে বুঝতে পারে না। সে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। কোন রকমে সব বিষয়ে পাশ করে। অংক একটু কম বোঝে। তাই প্রায় সময় ওকে মার খেতে হয়।
প্রধান শিক্ষক ওকে আদর করে বলল, আমাকে বল বাবা, আমি তোকে বকবো না। মানিক চোখ মুছে বলল, স্যার আমি এবার এবারের অংক পরীক্ষায় ১০০ নাম্বারের মধ্যে মাত্র ২০ নাম্বার পেয়ে ফেল করেছি। কিন্তু আমিতো চেষ্টা করেছি। অংক না বুঝলে আমি কি করব বলুন? অংক স্যার প্রায় আমাকে মারে HW খাতা দেখে। আমি ঠিকমত বাড়ির কাজও করতে পারি না। কিন্তু তাতে আমার দুঃখ নেই। না পারলে স্যার অবশ্যই মারবেন। তবে সেদিন ক্লাসে অংক খাতা দেখানোর পর আমাকে কান ধরে বেঞ্চের উপর দাঁড় করিয়ে রাখল। আর গাধার গাধা বলে গালি দিল। ক্লাসে সবাই হেসেছে। তাই আমি পরদিন থেকে স্কুলে যাচ্ছি না। আমি ঠিক করেছি আমি আর পড়ব না।
প্রধান শিক্ষক বললেন, দেখ মানিক, আমি যা বুঝলাম তোর অভিমান হয়েছে স্যারের উপর। কিন্তু একবার ভেবে দেখতো, তোর মা শুনলে কত কষ্ট পাবে। তোকে পড়ানোর জন্যই তো তোর মা চাকরি করছে। যাতে তুই লেখাপড়া শিখে বড় হয়ে তোর মায়ের কষ্ট দূর করতে পারিস। মানিক বলল, আমিও তো চেয়েছি স্যার, মায়ের কষ্ট দূর করতে। কিন্তু আমাকে কেউ গালি দিলে আমার খুব অপমান লাগে। আমার মা আমাকে কখনো গালি দেয়না। আমার সব আবদার যেভাবে পারে মেটায়।শুধু গৃহশিক্ষক দিতে পারছে না, কারণ মায়ের বেতন খুব কম। তারপরও মা বলেছে ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠলে তখন তো পড়া বেশি তখন অংক আর ইংরেজির জন্য আমাকে কোচিং এ ভর্তি করাবে।
প্রধান শিক্ষক বললেন, বেশ তাহলে তোকে আমি একটা কথা বলি। প্রতিদিন তুই টিফিন অথবা ছুটির সময় আমার রুমে আসবি। যে বিষয়ের পড়া পারবি না আমাকে বলবি। আমি বুঝিয়ে দেবো। মানিক বলল, কিন্তু স্যার, মা বলেছে এ বছর আমার জন্য কোন স্যার রাখতে পারবেনা। বেতন দেবো কিভাবে আপনাকে? স্যার হেসে বলল, হ্যাঁ সেটা তো ঠিক। আমি বেতন নেব না, তবে একটা কিছু তো দিতে হবে। মানিক মাথা চুলকিয়ে বলল, স্যার আমাদের ঘরে তো তেমন কিছুই নেই। আপনাকে কি দেব?স্যার হেসে বলল, এই যে অংক স্যারের প্রতি তোর অভিমান হয়েছে সেজন্য পড়ালেখা বন্ধ করে দিবি বলছিস। স্কুলে যাচ্ছিস না। কিন্তু এই রাগ থেকে তুই যদি আমার কাছে একটা কথা দিস যে, তুই অংক স্যারকে ভালো রেজাল্ট করে দেখিয়ে দিবি যে তুই গাধা নোস। চেষ্টা করলে তুই ক্লাসে ফার্স্ট ও হতে পারবি। বল, ভালো করে পড়বি তো? মানিকের চোখে আবার জল চলে আসল। তবে এটা কষ্টের নয়, আনন্দের। সে প্রধান শিক্ষককে প্রণাম করে বলল, স্যার, আমি কোনো পড়া বুঝলে তা মনে রাখতে পারি। আপনি যদি আমাকে বুঝিয়ে দেন আমিও চেষ্টা করব ভালো রেজাল্ট করতে। অংক স্যারকে বুঝিয়ে দেব কেউ ইচ্ছে করে গাধা হয় না। ঠিকমত সুযোগ পেলে সবাই রেজাল্ট ভালো করতে পারে। প্রধান শিক্ষক মানিকের পিঠ চাপড়ে বলল, এই তো সাবাস ছেলে। তাহলে কালকে কি স্কুলে যাচ্ছিস তো? মানিক বলল, হ্যাঁ স্যার অবশ্যই যাব। প্রতিদিনই যাব। প্রধান শিক্ষক বলল, একটা কথা মনে রাখবি, কারো উপর অভিমান করে নিজেকে কষ্ট না দিয়ে বরং আরো দৃঢ় হতে হবে নিজেকে নতুন করে তৈরি করার জন্য। ভালো মানুষ হওয়ার জন্য। মানিক বলল, স্যার, আপনি আমাকে আজ নতুন পথের ঠিকানা দিলেন। আমি আর পেছনে তাকাবো না। আপনার আদেশ মতো সামনে এগিয়ে যাব।
মানিক যদি অভিমান করে পড়াশোনা বন্ধ করে দিত তাহলে তার জীবন অন্ধকারে ভরে যেত। মায়ের স্বপ্ন পূরণ হতো না। ভাগ্যিস,আজ প্রধান শিক্ষকের সাথে দেখা হয়ে মানিক তার জীবনে আলোর পথের ঠিকানা খুঁজে পেল।
