লেখিকা : তামান্না হক
প্রথম দেখা
ঢাকার ব্যস্ত শহরের এক কোণে, ধানমণ্ডির এক চুপচাপ ক্যাফে—‘কফি ক্লাউড’। প্রতিদিন শত শত মুখ আসে-যায়, কিন্তু সে দিনটায় যেন বাতাসেও ছিল অন্যরকম কিছু। একে তো শীতের হালকা কুয়াশা, তার ওপর সন্ধ্যা নামার আগে একটা অদ্ভুত শান্ত-শব্দহীনতা।
নিলয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র, সাহিত্যের প্রতি অগাধ ভালোবাসা তার। কিন্তু বাস্তব জীবন আর কবিতার জীবন এক নয়—এটা সে হাড়ে হাড়ে টের পায় প্রতিদিন। সেদিন ক্যাফের কোণার টেবিলে বসে যখন সে নতুন একটা কবিতা লিখছিল, ঠিক তখনই তার সামনে এল মেয়েটি। শান্ত চোখ, মুখে অন্যমনস্কতার ছাপ, পরনে সাদামাটা পাঞ্জাবি আর নীল ওড়না।
—“এই টেবিলটা কি ফাঁকা?” মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো।
নিলয় চমকে উঠে তাকাল, একটু দ্বিধা নিয়ে বললো—
—“হ্যাঁ, অবশ্যই। বসতে পারেন।”
মেয়েটি বসে পড়লো, কিন্তু তারপর দীর্ঘ সময় দুজনেই চুপ। মাঝে মাঝে চোখাচোখি হচ্ছিল, কিন্তু কেউ কিছু বলছিল না। কেবল কফির কাপ আর খাতার পাতায় শব্দ হচ্ছিল।
ঠিক সেই মুহূর্তে, মেয়েটি পেছনের চেয়ার থেকে একটা বই তুলতে গিয়ে বইটা ফেলে দেয়। নিলয় হাতে তুলে দেয় বইটা। বইয়ের নাম দেখে সে অবাক—“শঙ্খচিলের পালক”।
—“তুমি এটা পড়ো?”
—“হ্যাঁ,” মেয়েটি হাসলো, “তুমি?”
—“আমার সবচেয়ে প্রিয় উপন্যাসগুলোর একটা…”
সেদিন কফির কাপ শেষ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু আলাপটা শুরু হয়েছিল সদ্য খোলা বইয়ের মতো।
কে জানতো, এই প্রথম দেখা তাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে।
কাছাকাছি
কফি শপের সেই প্রথম দেখা যেন মনের গহীনে এক রঙিন ছাপ রেখে গিয়েছিল। নিলয় ভাবেনি, এত সাধারণ একটা দুপুর তার জীবনের এমন বিশেষ অধ্যায় হয়ে যাবে। সেই দিন থেকে প্রতি বৃহস্পতিবার বিকেলে ‘কফি ক্লাউড’-এ দেখা হতে লাগলো তাদের।
আরিবার চোখে এক ধরনের গভীরতা ছিল, যেন অনেক কিছু বলতে চায়—তবুও চুপ থাকে। সে খুব কম কথা বলে, কিন্তু প্রতিটি বাক্যে একটা ছায়া থাকে, একটা ভাঙা সুর যেন।
নিলয় মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে—
—“তোমার প্রিয় কবি কে?”
আরিবা বলে, “যে কবি তার যন্ত্রণা গোপন করে হাসি লেখে…”
তাদের সম্পর্কের নাম কেউ দেয়নি, কিন্তু দুইটি হৃদয় ধীরে ধীরে একে অপরের ভাষা বুঝতে শিখছিল।
এক বিকেলে, হঠাৎ করেই নিলয় বলে উঠলো—
—“তুমি অনেক চুপচাপ… সবসময় নিজের মধ্যে কেন থাকো?”
আরিবার চোখ কিছুক্ষণের জন্য নিচু হয়ে গেল। তারপর সে বলল,
—“সব মানুষ নিজের ভেতরে একটা যুদ্ধ নিয়ে বাঁচে, নিলয়। কেউ দেখে না, শুধু টের পায়…”
সেই প্রথম নিলয়ের মনে হলো, মেয়েটা শুধু বই ভালোবাসে না—তার জীবনের প্রতিটা পাতাও হয়তো অনেক জটিলতায় ভরা।
সেদিন ক্যাফে থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময়, আরিবা প্রথমবারের মতো নিলয়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো।
নিলয়ের মনে হলো, যেন তার মনেও একটা দরজা খুলে গেল।
অন্তরালের গল্প
নিলয়ের মনে ছিল একটাই প্রশ্ন—আরিবার চোখ এত ক্লান্ত কেন?
একদিন, ভিন্নভাবে সাজানো ‘কফি ক্লাউড’—শুভ নববর্ষের আয়োজন। লোকজন বেশি, কিন্তু আরিবার মুখে সেই একই নিঃশব্দতা। আজ যেন তার চোখে আরও গভীর কিছু লুকানো।
—“আরিবা, আমি তোমায় জানতে চাই। পুরোটা না হোক, কিছুটা বলো না… কে তুমি?”
নিলয়ের প্রশ্নটা তার মতোই নরম, কিন্তু তীক্ষ্ণ।
আরিবা জানালার পাশে তাকিয়ে বলল—
—“আমি একবার বিশ্বাস করেছিলাম… ভেবেছিলাম, ভালোবাসা মানুষকে ভরসা দেয়। কিন্তু আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম নিজেকেই।”
সে থামে, তারপর ফিসফিস করে বলে—
—“আমার বাবা-মা ডিভোর্সের পরে আমি এক আত্মীয়র বাসায় বড় হয়েছি। সেখানে… মানসিক নিপীড়ন, অপমান—সবকিছু সয়ে কাটাতে হয়েছে। এখনো স্বপ্নে সেই দিনগুলো ফিরে আসে।”
নিলয় নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। সে কিছু বলতে চায়, কিন্তু ভাষা হারিয়ে ফেলে। শুধু বলে—
—“তুমি এখন একা নও।”
আরিবার চোখে জল আসে না, কিন্তু মুখটা কেঁপে ওঠে।
সে জানে, কেউ তার ভাঙা গল্প শুনছে, কেউ তাকে শুধু সহানুভূতিতে নয়—সমঝে ভালোবাসছে।
সেদিনের পরে তাদের সম্পর্কের রঙ বদলে গেল।
বন্ধুত্বের আড়ালে একটা অদৃশ্য টান তৈরি হলো—যা আর মুখে বলা হয়নি, কিন্তু দুই মন বুঝে গেল।
দূরত্ব ও সিদ্ধান্ত
সময় থেমে থাকে না, কিন্তু কিছু অনুভূতি সময়ের মধ্যেই আটকে যায়।
নিলয় ও আরিবার মধ্যে যে বন্ধন তৈরি হয়েছিল, তা সহজ ছিল না—কিন্তু গভীর ছিল।
তবে হঠাৎ করেই বদলে যেতে লাগল কিছু কিছু জিনিস।
আরিবা অনিয়মিত হয়ে গেল। ‘কফি ক্লাউড’-এ দেখা কমতে লাগল। ফোনেও উত্তর দিতে দেরি হতো।
নিলয় প্রথমে বুঝতে পারেনি, পরে ভাবতে শুরু করলো—আরিবা কি আবার তার অতীতের ভয়ে ডুবছে?
একদিন বিকেলে, হঠাৎ দেখা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল গেটের পাশে।
নিলয় জিজ্ঞেস করল—
—“তুমি দূরে চলে যাচ্ছ কেন?”
আরিবা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল—
—“কারো জীবনে বেশিক্ষণ থাকা মানে তাদের দায়িত্ব নেওয়া, নিলয়। আমি জানি না আমি সেটা পারবো কি না।”
নিলয় একটু কঠোর হয়ে বলল—
—“তুমি কি আমাকে বুঝতে দিচ্ছ না, না কি নিজের থেকে পালিয়ে যাচ্ছ?”
আরিবা চোখ সরিয়ে নেয়। তারপর আস্তে করে বলে—
—“আমার ভেতরে যা আছে, সেটা কেউ নিতে পারবে না… আমি নিজেকেই নিতে পারি না।”
সেদিন প্রথমবার, নিলয় তাকে কিছু না বলে চলে যায়।
তার বুক ফেটে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল—”থেকে যাও!” কিন্তু বলে না।
ঘরে ফিরে সে জানালার পাশে বসে কবিতার খাতাটা খুলে লেখে—
“যে চলে যায়, সে জানে না
ফিরে আসা কী অসম্ভব কঠিন।”
শেষ পৃষ্ঠা
নিলয়ের খাতার পাতায় আর কাব্য লেখা হচ্ছিল না।
আরিবার অনুপস্থিতি যেন প্রতিটি বাক্যকে শুষে নিচ্ছিল।
দিনের পর দিন কেটেছে, ‘কফি ক্লাউড’-এ সে একাই যায়—একই কোণার টেবিলে বসে।
কেউ আসে না।
একদিন, ক্যাম্পাসে একটা সাহিত্য প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়।
নিলয়ের কবিতা নির্বাচিত হয় উপস্থাপনার জন্য।
তাকে বলা হয়, দর্শকদের সামনে নিজের কবিতা পাঠ করতে।
মঞ্চে উঠে সে বলে,
—“এই কবিতা আমি উৎসর্গ করেছি তাকে, যে না থেকেও আমার ভেতরে সবচেয়ে বেশি বাস করে।”
তার কবিতার শেষ লাইন ছিল:
“আমি অন্তরালে ভালোবেসেছি,
তোমাকে না বলে—সব বলেছি।”
কবিতা শেষে যখন সে নিচে নেমে আসে, গ্যালারির এক কোণে হঠাৎ চোখে পড়ে এক পরিচিত মুখ।
আরিবা।
তাকে দেখে নিলয়ের মুখে বিস্ময় আর আবেগের ঢেউ।
আরিবা এগিয়ে এসে বলে—
—“তুমি না বলেও সব বলেছিলে, আমি শুনেছি।
ভয় পেয়েছিলাম, কিন্তু তোমার ভালোবাসা আমার ভয়কে হার মানিয়েছে।”
তার চোখে জল, কণ্ঠ ভারী।
নিলয় ধীরে হাত বাড়িয়ে বলে—
—“এবার চলো, একসঙ্গে লিখি আমাদের গল্পটা।”
সেদিন দুই ভাঙা হৃদয় একত্র হলো।
জীবনের সব না বলা কথা একটায় মিশে গেল—
ভালোবাসা।