আনিছুর রহমান একজন সাধারণ কর্মকর্তা। ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের একজন পরিদর্শক ।
মাসিক মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করতে স্বাস্থ্য অফিসে এসেছেন। মিটিং শুরু হতে দুপুর পার হয়ে গেলো। আনিছুর রহমান কর্মকর্তাদের আচরণে খুব বিরক্ত হয়ে গেলো। তিনি বিড়বিড় করে বলতে লাগলো এদের কোন সময় জ্ঞান নেই। আসলে আনিছুর রহমানেরই বা কি দোষ। থানা সদর থেকে প্রায় ২৫কি.মি.দূরে আনিছুর রহমানের বাড়ি। যদিও বা বাসে সবটা রাস্তা যাওয়া যেতো তাহলেও সমস্যা ছিলোনা। তাই সন্ধ্যা হবার আগে মতো তাড়াতাড়ি সম্ভব রওনা হওয়া যায় ততই ভালো। কিন্তু কি দুভার্গ্য মিটিং শেষ হলো মাগরিবের ও প্রায় ১ঘন্টা পর। আনিছুর রহমান তড়িঘড়ি করে বের হতে যাবে এমন সময় থানার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাক দিলেন। প্রচন্ড বিরক্তবোধ করলেও আনিছুর রহমান যতটুকু সম্ভব মুখে হাসি রেখে ঘুরে দাড়ালেন।থানা কর্মকর্তা ইশারায় তার রুমে যাওয়ার জন্য বললো। আনিছুর রহমান থানা কর্মকর্তার পিছু পিছু রুমে গেলেন। রুমে যেতেই কর্মকর্তা তাকে বসতে বললেন। প্রায় দেড় ঘন্টা বিভিন্ন রকম কথা-বার্তা বলে আনিছুর রহমানকে বিদায় দিলেন।
আনিছুর রহমান বাসস্ট্যান্ডে এসে দেখে কোন বাসই নেই। ঘড়িতে তখন রাত ১০টা ছুঁই ছুঁই। শহরগুলোতে এটা একটা সমস্যা। রাত ৮টার পরে কোন বাসই ছাড়তে চায়না। মোটামুটি ১০/১৫জন লোক এক জায়গায় জড়ো হয়েছে। কিন্তু কোন যানবাহনের চিহ্নটুকু নেই। আনিছুর রহমান চিন্তিত হয়ে পড়লেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর তিনি দেখলেন একটি ট্যাম্পু এগিয়ে আসলো। এই লোকগুলোকে একটি নির্দিষ্ট গন্তব্য পর্যন্ত ডাবল ভাড়ায় পৌঁছে দিতে রাজি হলো। ট্যাম্পুতে বসে আনিছুর রহমান খুবই দুশ্চিন্তা করতে লাগলো। এই পথটা না হয় ট্যাম্পুতে সবার সাথে চলে যাওয়া যাবে। বাকি পথটুকু কেমনে একা একা যাবে। গ্রামের দিকে তো ৮টা বাজতেই ভুতুড়ে নিরবতা সৃষ্টি হয়ে যায়। আনিছুর রহমান মনে মনে কিছুটা ভয় পেতে লাগলো। আনিছুর রহমান ট্যাম্পু থেকে নির্দিষ্ট গন্তব্যে নেমে একটা কোনার চা পানের দিকে পা বাড়ালো। আনিছুর রহমান থানা সদরে আসলে উনার সাইকেলটা কোনার ঔই চা-পানের দোকানে রেখে যায়। দোকানদার রহমত আলী খুবই ভালো একজন মানুষ। উনি দোকানের পাশাপাশি এগুলো ও নজর রাখে। বিনিময়ে কারো কাছ থেকে কিছু নেয়না। সবাই উনার দোকানে চা-পান খেয়ে যায়।
এই যা… আনিছুর রহমান কে দেখে রহমত আলী দেরি হওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলো। আনিছুর রহমান কারণ বলতেই পাশে দোকানের সামনে বেঞ্চিতে বসা একটি লোক বলে উঠলো সরকারি কর্মকর্তাদের সময় জ্ঞান বলে কিছু নেই। আনিছুর রহমান ও সায় জানালো। চা কাপে চিনি,দুধ দিতে দিতে রহমত আলী কয়েকবার আনিছুর রহমান কে আজ রাতে থেকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলো। আনিছুর রহমান বেশি রাত হওয়াতে ভয় পেলেও বলল,নারে ভাই থাকা যাবে না। বাড়িতে স্ত্রী -সন্তানেরা দুশ্চিন্তা করবে। রহমত আলী ও আনিছুর রহমানের কথা মেনে নিলো। তখন তো আর মোবাইলের কোন ব্যাপার ব্যাপার ছিলো না। যে কোন সমস্যা হলে বাড়িতে ফোন করে বলবে।যে বাড়ি ফেরা হবেনা চিন্তা করোনা। আনিছুর রহমান একটা পান মুখে দিয়ে সাইকেল নিয়ে রওনা হলো গ্রামের উদ্দেশ্যে।
আকাশে চাঁদ দেখে আনিছুর রহমান খুবই খুশি হলো।যাক চাঁদের আলোয় ভালোভাবে যাওয়া যাবে। গ্রামের নির্জন রাস্তা। গাছের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলোয় অদ্ভুত এক আলো-আধারের মায়াজাল বিছিয়ে রেখেছে রাস্তায়।পথে যেতে যেতে আনিছুর রহমান একটা অদ্ভূত জিনিস আবিষ্কার করলো । রাতের বেলা গাছের নিচে একটু ভাপসা গরম থাকে।ডানের মোড়ের জঙ্গলটায় হঠাৎ রুপালি একটা আভা চোখে পড়লো। আনিছুর রহমান কিছুটা চমকে উঠলো।সাইকেলের বেল দিতে দিতে আনিছুর রহমান ডানের মোড়টা ঘুরলো। আনিছুর রহমান মনে মন কিছুটা হাসলো। ডানের মোড়ে আসলে একটা বড়ো পুকুর আছে যেটায় চাঁদের আলো পড়ে রুপালি একটা আভা তৈরি করেছে। পুকুরের মাঝখানে একটা সাদা হাঁস একলা ভাসছে।
সামনেই কর্ফুলা গোরস্থান। আনিছুর রহমান আবার গোরস্থানকে ভয় পায় না।যদিও গোরস্থান নিয়ে অনেক কথা প্রচলিত আছে। আনিছুর রহমান আবার সাইকেলের বেল বাজাচ্ছে । রাস্তায় কেউ নেই তবুও আনিছুর রহমান ইচ্ছে করেই সাইকেলের বেল বাজাচ্ছে। গোরস্থানের মাঝখানের তেঁতুলগাছটা দেখা যাচ্ছে। কিছু মানুষের ফিসফাস কথা শোনা যাচ্ছে। আনিছুর রহমান লক্ষ্য করলো গোরস্থানের শেষ দিকে ১৫-২০জন সাদা চাদর -পরা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মুখ দেখা যাচ্ছে না।কেউ নড়ছে না,কেউ কিছু বলছে না।
শুধু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনে আরেকটা লাশের দিকে।লাশটি খুব সাদা, অস্বাভাবিক রকম সাদা। যেন চাঁদের আলোয় জ্বলে উঠেছে। তিনি ফিসফিস করে বললেন,
-“ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন…কে মারা গেলো?”
তখন একবারে পাশ থেকে কেউ ঠান্ডা গলায় বলল,
“আজ জানাযা তোর জন্য।”
আনিছুর রহমান চমকে পেছনে তাকালেন। কেউ নেই। আবার সামনে তাকাতেই দেখলেন – সব লোক উধাও! শুধু সেই লাশটা এখন উঠে বসে গেছে! লাল চোখ ফাঁকা চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকেই! কাপড়ের নিচ থেকে লম্বা কালো হাত বেরিয়ে আসছে, যেন টান দেবে, নিয়ে যাবে। এক মুহুর্ত ও দেরি না করে আনিছুর রহমান সাইকেল ফেলে দৌড় দিলেন। পেছনে স্পষ্ট শুনতে পেলেন ভেসে আসছে সেই শব্দ –
আয় জানাযা পড়ে যা…
চারদিকে ঘন কুয়াশা, পেছনে দাপ-দাপ-শব্দ কেউ কি পেছন থেকে ছুটে আসছে?
তারপর?
আর কিছু মনে নাই।
শুধু এতটুকু জানা যায় – পাওয়া গিয়েছিল।
আর আনিছুর রহমান?
তাকে আর কখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি।
গল্প পড়ে কেমন লাগলো জানাবেন প্লীজ।