একটি কাব্যিক গল্প, রবীন্দ্রনাথের ছায়ায়
১. জ্যোৎস্না সন্ধ্যার বাড়ি
শ্রাবণের শেষ সপ্তাহ। চারপাশে একরকম নিরবতা। বাতাসে হালকা বৃষ্টির গন্ধ। পুরনো জমিদার বাড়ির বারান্দায় বসে আছে চারুলতা — লালপাড় সাদা শাড়ি, কপালে ছোট্ট টিপ, চোখে একধরনের উদাসীনতা। চারুলতার বয়স এখন ত্রিশ ছুঁইছুঁই, কিন্তু তার চেহারায় এখনও সেই উনিশ বছরের কবিতার মতো সরলতা। যে বাড়িতে সে এসেছে বউ হয়ে, সে বাড়ির উঠোনে এখন ঝরা পাতার দল। স্বামী হেমাংশু কলকাতায় চাকরি করে — চিঠি লেখে, মাসে একবার এসে যায়, কিন্তু আজকাল কথার সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
চারু জানে না কেন, আজ সারাদিন তার বুকটা ভার হয়ে আছে। বুকের ভিতর যেন কোনো অচেনা কবিতা ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর সে তার মানে বুঝতে পারছে না।
সে চুপ করে বসে বলে উঠল:
“আজকে আমার মন ভালো নেই।”
২. পথের পানে চেয়ে
সন্ধ্যে নেমেছে। পাশের পুকুরের জলে জ্যোৎস্নার ছায়া পড়েছে। চারুলতা ছাদের মাথায় উঠে দাঁড়ায়। দূরে দেখা যায় মাঠের দিকে কেউ একজন হেঁটে আসছে — হাতে একটি বই, পরনে ধুতি আর কাঁধে শাল।
চেনা চেহারা। অরুণ।
অরুণ — এই বাড়ির লাইব্রেরিতে কাজ করা কবিসুলভ যুবক। সে গান লেখে, কবিতা পড়ে, এবং মাঝে মাঝে চারুলতার কাছে কিছু বই ধার নেয়।
চারুলতা তার দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে পড়ে, রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’ নাটকের একটি সংলাপ:
“আমি চিত্রাঙ্গদা, আমি রাজপুত্র, আমি নারী নই ভিখারিনী, যুদ্ধ জানি, প্রেম জানি না।”
আজ তার নিজের কথাগুলো যেন ছন্দে মিলিয়ে যায়:
“আমি চারুলতা, আমি স্তব্ধতা, আমি বধূ, কিন্তু একা।”
অরুণ উঠোন পেরিয়ে বারান্দায় এল।
— “বৌঠান, আজ একটা নতুন কবিতা লিখেছি। ভাবছিলাম আপনাকে শোনাই।”
— “শুনাও,” চারু বলল, কিন্তু কণ্ঠে কোনো সুর নেই।
অরুণ কবিতা পড়ল:
“যে ব্যথা বলিনি কভু, সে কথা
জলের নিচে ঢেকে থাকা পাতার মত
নীরব, কিন্তু মলিন নয়।
সে কথা চোখে থাকে, ঠোঁটে নয়।”
চারুলতা কিছু বলল না। হঠাৎ হালকা হেসে বলল,
— “আজ তোমার কবিতায় আমার মন নেই অরুণ। আজকে আমার মন ভালো নেই।”
৩. চিঠির অভাব
রাতে চারুলতা ঘরে বসে চিঠি পড়ছিল — হেমাংশুর পাঠানো চিঠি। সবগুলোতেই একরকম কথা — অফিসের কাজ, শরীরের খবর, চারুলতার জন্য শুভ কামনা।
কিন্তু কোথাও নেই — “তুমি কেমন আছো?”, “তোমার চোখের তলায় ক্লান্তির রেখা কেন?”, বা “তোমার চুল কি আগের মতো উড়ছে?” — এ রকম কোনো প্রশ্ন নেই।
চারু হঠাৎ কলম হাতে নেয়। একটি কাগজে লিখে ফেলে:
“হেমাংশু,
আজকে আমার মন ভালো নেই।
জানি না কেন, তবে মনে হয় তুমি কবে থেকে যেন আমাকে পড়তে ভুলে গেছ।
আমি যেন শুধুই একজন স্ত্রী হয়ে গেছি, নারী হয়ে যাইনি।
আমি কাঁদি না, কারণ কাঁদলে আর তুমি শোনো না।
আমি হাসিও না, কারণ তাতে তুমি ফিরে আসো না।
শুধু আজ, এই শ্রাবণের রাতে, আমি তোমার কাছে কিছু চাই না। শুধু জানতে চাই — তুমি কি কখনও ফিরে এসে আমাকে আবার ভালোবাসতে পারবে?”
চিঠিটা শেষ করে চারুলতা একবারও ভাঁজ করল না। ছেঁড়া শেষ পাতায় কবিতা হয়ে থেকে গেল।
৪. সন্ধ্যার নরম আলোয়
পরদিন বিকেলে চারুলতা অরুণকে ডেকে বলল,
— “আজ কিছু পড়তে হবে না। শুধু বসো। আমি কথা বলব।”
অরুণ চুপচাপ বসে।
চারুলতা বলে,
— “তুমি জানো অরুণ, একদিন আমি কবিতা লিখতাম। এখন লিখি না। কারণ আমার জীবনটাই যেন এক অপূর্ণ কবিতা হয়ে গেছে। তুমি বুঝবে?”
অরুণ মাথা নিচু করে থাকে। বলে না কিছু। কিন্তু তার চোখে একপ্রকার ব্যথা।
চারু উঠে দাঁড়িয়ে জানালার দিকে চেয়ে বলল,
— “আমি প্রতিদিন সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে হারিয়ে ফেলি। এমন একটা দিন আসে না, যেদিন আমি আমার ‘আমি’কে খুঁজে পাই। আজকে আমার মন ভালো নেই, অরুণ। কারণ আমি জানি, আগামীকালও এই একইভাবে কাটবে।”
৫. অপ্রকাশিত ভালোবাসা
অরুণ চলে গেলে চারু ধীরে ধীরে চিঠিটা পুড়িয়ে ফেলে। জানে, হেমাংশুর কাছে এই কথা পৌঁছালেও কিছুই বদলাবে না। তার ভিতরে অন্য এক প্রেম জন্ম নিচ্ছে — প্রেম নয়ত সহানুভূতি, অথবা কবিতার প্রতি ভালোবাসা — ঠিক ব্যাখ্যা করা যায় না।
রবীন্দ্রনাথের “শেষের কবিতা” মনে পড়ে তার। লাবণ্য যেমন বলেছিল:
“এই ভালোবাসা নয়, এই আত্মার স্পর্শ। আমি জানি না এই ভালোবাসা কতটুকু চায়, কিন্তু আমি এটুকু জানি — সে কিছু রেখে যায়।”
৬. নতুন সকাল
পরদিন ভোরে চারুলতা নিজের আয়নার সামনে দাঁড়ায়। চুল বাঁধে, কপালে টিপ পরে। তারপর গলায় একতারা ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ে কাছের নদীর ধারে — যেখানে ছোট শিশুরা স্কুলে যাচ্ছে, নারীরা কলসি মাথায় করে জল আনছে।
সে দেখে, জীবন এখনও চলমান। সবাই নিজ নিজ জীবন নিয়ে ব্যস্ত, আর সে বসে থাকে — থেমে থাকা সময়ের মতো।
তবে আজ আর নয়।
সে হাঁটতে হাঁটতে বলে,
— “আজও আমার মন ভালো নেই। কিন্তু আজ আমি তার মানে জানি। আজ আমি সেই কষ্ট নিয়ে নিজের কবিতা লিখব।”
শেষাংশ:
বাড়ি ফিরে চারুলতা নতুন খাতা খুলে লিখে:
“আজকে আমার মন ভালো নেই,
কারণ আজও আমি হারিয়েছি কিছু স্বপ্ন।
তবে আজ আমি ভেঙে পড়িনি।
আমি সেই স্বপ্নকে ছুঁয়ে আবার গড়ব নতুন এক সকাল।
আমি শুধু চারুলতা নই,
আমি রবীন্দ্রনাথের ‘স্ত্রী’, ‘নারী’, ‘প্রেম’, ‘প্রতীক্ষা’।
আমি এখন আর কারো অপেক্ষায় নেই,
আমি নিজেই এক কবিতা।”
এই গল্প রবীন্দ্রনাথের কাব্যচরিত্রগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে লেখা — যেমন চোখের বালি‘র বিনোদিনী, শেষের কবিতা‘র লাবণ্য, কিংবা নষ্টনীড়‘র চারুলতা। তারা সবাই প্রেমে, প্রতীক্ষায়, বেদনায় পূর্ণ, কিন্তু প্রত্যেকেই নিজেদের মতো করে শক্তিশালী, সাহসী।
Very good
Thank you
My pleasure
Very good
Good
Thank you so much
Very good
Very good