লেখিকা: জেরিন জাহান দিশা
হাসান সাহেব এক সময় একজন সাধারণ মানুষ ছিলেন। তার ব্যবসা ছিল ছোট, আর জীবনের সংগ্রাম ছিল প্রতিদিনের সঙ্গী। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে একসময় তার ব্যবসায় বড় ক্ষতি হয়। ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েন তিনি। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন—কেউ পাশে দাঁড়ায়নি। তবে তার স্ত্রী সাইলা বেগম ছিলেন এক আলোকবর্তিকা—চুপচাপ, সাহসী এবং অটুট।
হাসান সাহেব যখন হতাশায় ডুবে যান, তখন সাইলা বেগম নিজের গহনা খুলে স্বামীর হাতে দিয়ে বলেন,
“এই টাকায় আবার শুরু করো। আমি তোমার পাশে আছি।”
এই কথায় যেন প্রাণ ফিরে পান হাসান সাহেব। নতুন করে ব্যবসা শুরু করেন, আর ভাগ্য এবার সঙ্গ দেয়। ধীরে ধীরে সফলতা আসে, তিনি হয়ে ওঠেন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী।
তারা কখনো ভুলে যাননি সেই দুর্দিনের কথা। আজও কেউ বিপদে পড়লে, হাসান সাহেব ও সাইলা বেগম সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেন।
একদিন তাদের ঘরে আসে এক নতুন প্রাণ—একটি পুত্রসন্তান। নাম রাখেন আকাশ। আকাশ হয়ে ওঠে বাবা-মায়ের গর্ব, চোখের মণি।
আকাশ পড়াশোনায় খুব ভালো। ভদ্র, বিনয়ী ও সহানুভূতিশীল। হাসান সাহেব সবসময় বলেন,
“কাউকে ছোট ভাবিস না। সবার পাশে থাকবি।”
এসএসসি পরীক্ষার সময় আকাশ অনেক পরিশ্রম করে। মা পাশে বসে রাত জাগে, ছেলের খেয়াল রাখে। পরীক্ষায় গোল্ডেন এ+ পেয়ে সবাইকে গর্বিত করে আকাশ। এরপর কলেজে ভর্তি হয়।
কলেজের প্রথম দিনেই আকাশের চোখে পড়ে একটি মেয়ে—মায়াবী চেহারা, শান্ত চলাফেরা। নাম মিলি। প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে যায় আকাশ।
কিন্তু মিলির মনের দেয়ালে ছিল অতীতের দুঃসহ স্মৃতি। তার বড় বোন লিলির মৃত্যু তাকে বড়লোক ছেলেদের ওপর বিশ্বাস হারাতে শিখিয়েছে। তাই প্রথমে আকাশকে দূরে রাখে।
আকাশ বুঝে যায়, মিলিকে সময় দিতে হবে। ধৈর্য ধরে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। শ্রদ্ধা, সহানুভূতি আর নির্ভরতার হাত ধরে মিলির মন গলে যায়।
এক বিকেলে তারা ‘জ্যোতি ধাম’-এর পাশে বসে। আকাশ চুপচাপ বলে,
“তোমাকে ভালোবাসি।”
মিলি চোখ নামিয়ে ফিসফিস করে,
“তুমিই আমার বিশ্বাস ফিরিয়ে এনেছো।”
এরপর শুরু হয় ভালোবাসার দিনগুলো। তারা একসাথে পড়ে, হাঁটে, স্বপ্ন দেখে।
একদিন আকাশ বাবা-মায়ের কাছে মিলির কথা বলে। সাইলা বেগম বলেন,
“যার চোখে সত্যিকারের সম্মান আছে, তাকেই জীবনসঙ্গী করো।”
মিলির মা-ও শেষমেশ রাজি হন।
সরল এক অনুষ্ঠানে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয় আকাশ ও মিলি। চারদিকে ছিল আত্মীয়-স্বজনের হাসি আর হৃদয় ছোঁয়া আনন্দ।
নতুন ঘর, নতুন সংসার শুরু হয় ভালোবাসা আর বিশ্বাস দিয়ে। মিলি পড়াশোনার পাশাপাশি আকাশের ব্যবসায় সাহায্য করে। তারা একসাথে স্বপ্ন দেখে—একটা সংসার, যেখানে থাকবে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর একে অপরের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি।
একদিন মিলি আকাশকে বলে,
“এই ঘরে এখনও অনেক কিছু নেই, কিন্তু আমাদের ভালোবাসা আছে। সেটাই সবচেয়ে বড় সম্পদ।”
আকাশ হেসে বলে,
“তোমার ভালোবাসা দিয়েই তো ঘরটা ঘর হয়েছে।”
একদিন রাতে আকাশ মিলিকে নিয়ে ছাদে যায়। বলে,
“আমরা দুজন এই জ্যোৎস্না আলোয় সারারাত জেগে গল্প করবো।”
দুজন ছোটবেলার শৈশব স্মৃতি নিয়ে গল্প করতে থাকে। সময় কাটতে কাটতে রাত প্রায় তিনটা বাজে। আকাশ বলে,
“চলো, অনেক রাত হয়ে গেছে। এখন ঘুমাতে হবে, নইলে সকালে উঠতে পারবো না।”
ওরা দুজন একে অপরের হাত ধরে ঘরের দিকে রওনা দেয়। এমন সময় সিঁড়ির ধাপে পা বাড়াতেই মিলি হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। তার পা সঙ্গে সঙ্গেই ফুলে যায়, দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না।
আকাশ মিলিকে কোলে তুলে নিজের রুমে নিয়ে আসে। বিছানায় শুইয়ে দেয়, ওষুধের বক্স থেকে ব্যথানাশক ওষুধ খাইয়ে দেয়। কিন্তু ব্যথার সঙ্গে সঙ্গে মিলির জ্বর চলে আসে।
আকাশ কিছুই বুঝতে পারে না। সে আস্তে আস্তে মায়ের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। গিয়ে বলে,
“মা! মা!”
সাইলা বেগম ছেলের ডাক শুনে দরজা খুলে দেন।
“কি হয়েছে বাবা? তোকে এত অস্থির লাগছে কেন?”
আকাশ সব ঘটনা খুলে বলে। সাইলা বেগম তখন হাসান সাহেবকে ঘুম থেকে তুলে দেন। বলেন,
“একটা ডাক্তারকে ফোন দাও।”
সাইলা বেগম ও আকাশ মিলির কাছে যান। তিনি মিলির কপালে হাত দিয়ে দেখেন, প্রচণ্ড জ্বর। বলেন,
“আকাশ, একটা পাত্রে পানি নিয়ে আয়, জলপট্টি দিতে হবে।”
আকাশ পানি এনে দেয়। সাইলা বেগম জলপট্টি দেন। এমন সময় হাসান সাহেব ঘরে ঢুকে বলেন,
“ডাক্তারকে ফোন দিয়েছি। সে আসছে।”
তিনি বলেন,
“আকাশ, ওষুধের বক্সে দেখ তো জ্বরের ওষুধ আছে কিনা।”
আকাশ গিয়ে দেখে, একটি ওষুধ আছে। হাসান সাহেব বলেন,
“এক্ষুনি মিলিকে ওষুধ খাইয়ে দাও।”
আকাশ মিলিকে ওষুধ খাইয়ে দেয়।
এমন সময় কলিং বেলের আওয়াজ। হাসান সাহেব গিয়ে ডাক্তারকে আনেন।
ডাক্তার এসে বলেন,
“আমি ব্যথা ও জ্বরের ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি।”
আকাশ বলেন,
“আমি ওষুধ খাইয়ে দিয়েছি।”
ডাক্তার বলেন,
“ভালো করেছো আকাশ। তবে আবার কিছুক্ষণ পর এই ওষুধটা খাইয়ে দেবে। ইনশাআল্লাহ দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে।”
ডাক্তার বিদায় নিয়ে চলে যান।
ভোরবেলা মিলির ঘুম ভাঙে। দেখে, সবাই তার পাশে বসে আছে। তার চোখে পানি চলে আসে। মনে মনে বলে,
“এ বাড়ির সবাই আমাকে কত ভালোবাসে! আমি ভুল করেছিলাম, ভেবেছিলাম বড়লোকেরা খারাপ হয়।”
মিলি ডাক দেন,
“মা…”
সাইলা বেগম হকচকিয়ে উঠে বলেন,
“তোমার শরীর কেমন এখন? আবার জ্বর এসেছে?”
মিলি বলেন,
“না মা, আমি ভালো আছি।”
আকাশ ও হাসান সাহেব কথাগুলো শুনে উঠে পড়েন।
মিলি বলেন,
“আজ আমি খুব খুশি। কারণ আমি আগে ভাবতাম বড়লোকেরা খারাপ হয়, ওদের ভিতর ভালোবাসা থাকে না। আপনারা আমার সেই ভুলটা ভেঙে দিয়েছেন।”
সাইলা বেগম বলেন,
“তুমি অত কথা বলো না। তুমি এখনও অসুস্থ আছো।”
হাসান সাহেব বলেন,
“মিলি মামনি, তুমি সুস্থ হলে আমরা সবাই মিলে বেড়াতে যাবো।”
সাইলা বেগম বলেন,
“আকাশ, এখন তুমি মিলির পাশেই থাকো। আমি সকালের নাশতা বানাচ্ছি।”
হাসান সাহেব বলেন,
“মিলি মামনি, আমি এখন অফিসে যাচ্ছি। কোনো সমস্যা হলে বলো, ডাক্তারকে ফোন করবো।”
সাইলা বেগম ও হাসান সাহেব ঘর থেকে বের হয়ে যান।
আকাশ মিলির পাশে বসে বলেন,
“আমার জন্য তোমার পায়ে ব্যথা পেলো, ক্ষমা করো।”
মিলি মৃদু হেসে বলেন,
“তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাইলে আমি খারাপ লাগবো। বরং তোমার কারণে আমি বুঝতে পেরেছি, বাবা-মা আমাকে কত ভালোবাসেন।”
আকাশ দুষ্টুমি করে বলে,
“আমি ভালোবাসি না।”
মিলি লজ্জা পেয়ে যায়।
সপ্তাহ খানেক পর মিলি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠে। হাসান সাহেব বলেন,
“চলো, সবাই মিলে একটু বেড়িয়ে আসি। ঘুরতে গেলে মন ভালো থাকে।”
বেড়াতে যাওয়ার কথা শুনে মিলি মহাখুশি। পরিবারের সবাইকে নিয়ে হাসান সাহেব বেড়াতে নিয়ে গেলেন।