বাড়িতে একটাই টিভি ছিলো। কার্টুন দেখার জন্য সারাদিন বসে থাকতাম, কখন জানি রিমোটটা হাতে পাই… এখন টিভিটা ঘর সাজানোর আসবাবের মতো পড়ে থাকে, কেউ একটু অন করার সময়টাও পায় না…
একটা সময় ছিলো, যখন স্কুল ছুটির পর স্কুল গেটের সামনের আইসক্রিম মামার কাছ থেকে পাঁচ টাকার আইসক্রিম খাবার জন্য মুখিয়ে থাকতাম, মনটা আঁকুপাঁকু করতো। অথচ আমায় প্রতিদিন পাঁচ টাকা দেবে কে? এখন পার্সে পাঁচশ টাকার কম নিয়ে বের হওয়া হয় না। কিন্তু এখন আর সে পাঁচ টাকার আইসক্রিম আমাকে আগের মতো টানে না। আইসক্রিম দেখলেই মনে হয়, খেলেই তো ঠান্ডা লেগে যাবে… আহা, একদিনের পাঁচ টাকার আইসক্রিম আজ পনেরো বছর পরের দীর্ঘশ্বাস!
কোচিং ছুটির পর ঝালমুড়ি খেতাম সব বান্ধবীরা মিলে, আজকাল কাউকে ঝালমুড়ি খেতে দেখলে বিরক্তিতে ঠোঁট বেঁকে যায়। ইস, এসব রাস্তার পাশের খাবার কেউ খায়? পেট খারাপ হলে মজা টের পাবে… এককালের আড্ডার খোরাক আজ আমার বিদ্রুপের কারন!
পহেলা বৈশাখে লাল জমিনের সাদা পাড় শাড়ী পরে মেলায় যাবার কতো সখ ছিলো, বাবার শাসন আর মায়ের বারনের আড়ালে সে সখ কবেই স্মৃতির পাতায় হারিয়ে গেছে। আজকাল বাচ্চাদের পহেলা বৈশাখ উদযাপন করতে দেখলে মনে হয় এসব ছেলেমানুষি করে শুধুই সময় নষ্ট… হায়রে, একসময়কার সখের পহেলা বৈশাখ আজ কেবলই মূল্যবান সময়ের অপচয়!
বসন্ত উৎসবে যখন পাড়ার মেলায় নাগরদোলা ঘুরতো তখন দূরে দাঁড়িয়ে হাততালি দিতাম, লাইন ধরে নাগরদোলায় চড়তাম। তখন নাগরদৌলার গোল গোল ঘুরার মাঝেও কতো আনন্দ ছিলো। আজ নাগরদোলার দিকে তাকালে মাথা ঘোরে, মনে হয় এ আবার কেমন মজা! একদিনের আনন্দের খোরাক নাগরদোলা আজ আমারই বিরক্তির কারন।
কলেজ জীবনে বন্ধুদের সঙ্গে একটাবার পিকনিকে যাবার জন্য কতোবার বাবা-মাকে অনুরোধ করতে হয়েছে তার হিসেব নেই। মনে হতো, ইস একটু সময় যদি ওদের সংস্পর্শে না থাকি তবে না জানি কি মিস করে যাবো! অথচ আজকাল যখন সবাই একত্রিত হয় তখন নানা ব্যস্ততায় আর দেখা করা হয় না। হাহ, দেখা করার সময় কই?
ভার্সিটির কাঁঠাল গাছতলায় কি সুন্দর ছায়া ছিলো, গাছের নিচের বেঞ্চে বসে বই পড়ার মাঝে কতোই না তৃপ্তি ছিলো। এখন আর গাছতলায় যেতে মন চায় না, মনের মাঝে ভয় বাসা বাঁধে। এই বুঝি পাখি এসে দামী জামাটা নষ্ট করে দিলো। তাছাড়া, ব্যস্ততা ভরা জীবনে বই পড়ার সময় কই? আহা, ভার্সিটির কাঁঠালতলা, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র… কোথায় হারালো সব? মনের মাঝে একটাই উত্তর উঁকি মারে, সময় সবটা কেড়ে নিয়েছে!
বন্ধুদের সঙ্গে একবার সাত দিনের ট্যুরে যাবার জন্য কতো কান্নাকাটি, না খেয়ে থাকা। আজ হাতভর্তি টাকা, অথচ ট্যুরে যেতে আলসেমি লাগে। মনে হয়, ঘুরতে গেলেই তো হাঁটতে হবে… এতো হাঁটার বয়স কি আর আছে!
বিয়ের প্রথমদিকে বর সম্বোধনের মানুষটার সঙ্গে একটু সময় কাটানোর জন্য মনটা উদগ্রীব হয়ে থাকতো। আর আজকাল দরকার ছাড়া কথাও হয় না! সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের রঙটাও কেমন ফিকে হয়ে গেলো…
আমার মেয়েটা সম্ভবত প্রেমে পড়েছে, আসলে কাঁচা বয়স তো। আমিও পড়েছিলাম, অসময়ের প্রেম যাকে বলে আর কি… মানুষ ভার্সিটিতে পড়াকালীন নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখে, আমি দেখেছিলাম নতুন সংসারের স্বপ্ন। আমার সে অসময়ের স্বপ্ন আজ আমার সারাজীবনের মনকষ্টে পরিণত হয়েছে। আহা, কোথায় হারালো সেই মটরসাইকেলে বসা নীল শার্টের চমৎকার হাসির ছেলেটা!
সময় বয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে বয়ে যাচ্ছে আমার মনে মাঝে গড়ে ওঠা হাজার স্বপ্ন। আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে দাঁড়িয়ে বিগত দিনের সব স্বপ্নকে নেহাতই ছেলেমানুষি মনে হয়। অথচ একদিন এই ছেলেমানুষিগুলোকে ঘিরেই ছিলো তৃপ্তির হাসি… কিছু কিছু আনন্দ সময়ের হয়, সময়ে পেলে তা অমৃত আর অসয়ে পেলে তা তিক্ত… আমার ইচ্ছেগুলো সম্ভবত তিক্ততার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। তবে একটা জিনিসের পরিবর্তন হয় নি। তা হলো, বৃষ্টিপ্রেম! আগে বৃষ্টি দেখলে মনে হতো আহা কতো অপেক্ষার বৃষ্টি এলো। ছুট্টে চলে যেতাম বৃষ্টির পানিতে একটুখানি গা ভেজাতে… এখনো বৃষ্টি হলে আনন্দ হয়, বৃষ্টির দিনে যে ভালো ঘুম হয়! বৃষ্টিটা সেই আগের মতোই আছে কেবল আমার পছন্দ করার কারন বদলে গেছে…
সময় আর বয়স অনেক কিছু বদলে দেয়। পছন্দ, পছন্দের বস্তু, পছন্দের মানুষ সব… আহা, সময়কে যদি বেঁধে রাখতে পারতাম!
মায়ের ডায়েরীটা পড়ে মিতির দীর্ঘশ্বাস বাতাসে মিলিয়ে যায়, সে ভেবেছিলো মায়ের ডায়েরী পড়ে মায়ের জন্মদিনে মায়ের পছন্দের জিনিসগুলো উপহার দেবে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মায়ের পছন্দগুলো যে দীর্ঘশ্বাসে পরিণত হয়েছে। হয়তো আজ আর স্বপ্নগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই, তাদের অবস্থান কেবল এই রোজনামচার পাতায়… মিতি বিড়বিড় করে বললো, “জীবনের যে স্বপ্ন যথা সময়ে পূরণ না হয় তা পরবর্তীতে কখনো পূরণ না হোক। যথা সময়ে স্বপ্ন পূরণ না হবার কষ্টের তুলনায় ভুল সময়ে হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন পূরণ হবার কষ্ট যেনো কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেবার মতো!”
“সমাপ্ত”