আগের দিনের গাউন পরা গ্লামারাস অতসীর তুলনায় আজকের অতসী তার চোখে অপরূপা। কিন্তু পিথিউশা তো জানে না, সে দু’টো ভিন্ন মানুষের সঙ্গে ভিন্ন সময়ে কথা বলছে। এই ভুল বোঝাবুঝির শেষ কোথায়?
বাড়ি ফিরে পিথিউশার মনে হলো, অতসী একই শরীরে দুটো ভিন্ন জীবন যাপন করছে। প্রকৃতরূপে সে মমতাময়ী আর কর্মক্ষেত্রে সে অভিনেত্রী। বাহিরে নিজের ভাবমূর্তি বজায় রাখার কি নিখুঁত চেষ্টা তার, অথচ আশ্রমে তাকে দেখে মনে হলো সে নিজের জীবন নিয়ে কতোই না সন্তুষ্ট! আজকে অতসীকে দেখে পিথিউশা নিশ্চিত যে তার অর্ধাঙ্গিনী হবার যোগ্যতা কেবল অতসীরই আছে। সাধারণ সুতি শাড়ী পরা, খোলা চুলের বউ বউ অতসীকেই সে চায়… গাউন পরা, মুখে মেকি হাসি আঁকা অতসীকে তার চাই না। সে চায় সত্য অতসীকে, যে অচেনা-অজানা মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তৃপ্ত হয়, যে মুখে রঙ মেখে সং সাজে না, প্রকৃতি যার রূপের আয়না তাকে নকল সাজে মানায় না। সে তার প্রাকৃতিক রূপেই অপরূপা!
অন্যদিকে অরিত্রীর মনটা খচখচ করছে, পিথিউশার কাছে নিজের পরিচয় গোপন রাখায় তার মন ছটফট করছে। মিথ্যা পরিচয়, মিথ্যা জীবন সে চায় না। অতসীর প্রতি পিথিউশার আগ্রহ আছে তা প্রথম দেখাতেই বুঝেছে অরিত্রী, আশ্রমে তাকে অতসী ভেবেই হয়তো পিথিউশা আশ্রমের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে। পিথিউশা যদি জানে সে অতসী নয়, সামান্য কেউ তবে কি পিথিউশা আশ্রমের প্রতি জন্মানো আগ্রহ হারাবে না! পিথিউশাকে সত্য জানাবে ভেবেও সিদ্ধান্ত বদলালো অরিত্রী, সে তো আর নিজে থেকে পিথিউশাকে মিথ্যে পরিচয় দেয় নি, সে কেবল সত্য জানায় নি। একটা মিথ্যার জন্য যদি আশ্রমের এতোগুলো মানুষের ভালো হয় তবে হোক না। তার তো কোনো ক্ষতি হচ্ছে না… মানুষের একটা অদ্ভুত গুণ হলো, সে কোনো ভুল করলে তাকে শোধরানোর পরিবর্তে তাকে সঠিক প্রমান করার জন্য একের পর এক যুক্তি দাঁড় করাতে থাকে। অরিত্রীর ক্ষেত্রেও ঘটনা ব্যতিক্রম নয়। তার অবচেতন মন জানে সে ভুল করছে, কিন্তু তার জাগ্রত মন তাকে বলছে সে যা করছে ঠিক করছে, আশ্রমের ভালোর জন্য করছে। ওই মানুষটার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই, এ মিথ্যা তার বা পিথিউশার জন্য কোনো ক্ষতি বয়ে আনবে না। অথচ নিয়তির খেলা সম্পর্কে একেবারেই উদাসীন সে, অরিত্রীর ধারনা নেই এই একটা সত্য লুকোনোর ফল তার ভবিষ্যত জীবনের মোড় কোন দিকে নিয়ে যাবে…
১২
সময় তার নিজ গতিতে চলছে, আজকাল প্রায়ই পিথিউশাকে আশ্রমে আসতে দেখা যায়। অরিত্রীর সঙ্গে তার সখ্যতাও তুলনামূলক বেড়েছে তবে অরিত্রীর জড়তা আজও কাটে নি। প্রতি মুহূর্তে সে মিথ্যা বলার অনুতাপে অনুতপ্ত হচ্ছে আবার পিথিউশাকে বলতে গিয়ে বলতেও পারছে না। অদ্ভুত হলেও সত্য আজকাল আর বেনামী কোনো চিরকুট আসে না অরিত্রীদের বাড়িতে, এছাড়া অরিত্রীকেও আর ওই আগুন্তুক টানে না। তার মন জুড়ে কেবল পিথিউশাকে নিজের সত্য পরিচয় না বলতে পারার অনুতাপ…
ঈশান প্রায়ই অতসীর সেটে হাজির হয়, তার নানারকম মজার কথায় অতসীকে বিরক্ত করে তুলে। বিরক্ত হলেও কড়া কথা শুনাতে পারে না অতসী, ওই মুখটার দিকে তাকালে ঝুপ করে রাগ পড়ে যায়। একদিন শুটিং শেষে ফেরার সময় ঈশান অতসীকে বললো,
-‘আমার ভাবী হবেন না?’
অতসীর সেদিন বেশ রাগ চড়ে গেলো, রণচণ্ডী রূপ ধারন করে বললো,
-‘ভাবী হবো না, বউ হবো। বানাবেন?’
কথাটা শুনে ঈশানের মুখটা চুপসে গেলো, মনের মাঝে পিথিউশার মুখটা ভেসে উঠলো তৎক্ষণাৎ, কোনোপ্রকার উচ্চবাচ্য না করে প্রস্থান করলো সে। সিদ্ধান্ত নিলো, অতসীর কাছে আর যাবে না সে। ভাইয়ের জন্য বউ ঠিক করতে গিয়ে নিজের বউ জুটানোর ইচ্ছে নেই তার। তাছাড়া, পিথিউশা যদি জানে যে অতসী আর ঈশানের মাঝে বিন্দু পরিমান আকর্ষণ আছে তবে সে সরে যাবে। নিজের জন্য পিথিউশাকে বারংবার ত্যাগ স্বীকার করতে দেখেছে ঈশান, তাই নতুন করে আর ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু কেড়ে নিতে চায় না সে। বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে যেতে মন চাইলো না ঈশানের, সরাসরি ছাদে চলে গেলো সে। পিথিউষা চাদরগায়ে বসে আছে ছাদের একটা কোণে, পিথিউশার হাস্যোজ্জ্বল মুখটা দেখে সব মন খারাপ নিমিষে উড়ে গেলো। পিথিউশার পাশে বসে বললো,
-‘ভাইয়া, তোকে বেশ খুশি খুশি লাগছে। প্রমোশন হলো বুঝি?’
পিথিউশা তার দাম্ভিক হাসি হাসলো, ক্ষণিক বিরতি নিয়ে বললো,
-‘কেবল প্রমোশন হলে আমি খুশি হই? এছাড়া হই না?’
ঈশান গালের নিচে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলো, তারপর বেশ গম্ভীরভাবে বললো,
-‘খুব কম… তা তোর মনের রানীর খবর কি ভাইয়া? দেখা সাক্ষাত করেছিস?’
-‘গত সপ্তাহে প্রতিদিন দেখা হয়েছে, মনে হচ্ছে তার আমাকে ভীষণ পছন্দ তবে…’
-‘তবে?’
পিথিউশা খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, শান্ত অথচ গম্ভীর স্বরে বলে,
-‘ভেবেছিলাম প্রথমে ওর ঠিকানাতে বেনামে চিঠি আর ফুল পাঠিয়ে আমার প্রতি সুপ্ত আকর্ষণ তৈরি করবো। তারপর একদিন হুট করে সামনে গিয়ে চমকে দিবো, মনের কথা সবিস্তারে ব্যক্ত করে দেব। কিন্তু হঠাৎ সব বদলে গেছে, আমার সঙ্গে ওর প্রতিনিয়ত কথা হচ্ছে, একে অপরকে চেনার চেষ্টা করছি। তবুও অতসীর জড়তা কাটছে না, ও আমাকে না এড়িয়ে চলে না সরাসরি কথা বলে। কেমন যেনো নিজের মাঝেই মগ্ন থাকে মেয়েটা। আমি স্বস্তি পাই না। তাছাড়া ওকে সবার সামনে অতসী ডাকতে…’
অরিত্রী যে তাকে সবার সামনে অতসী ডাকতে মানা করেছে কথাটা বলতে গিয়েও বললো না পিথিউশা। ভাবলো অতসীর ছদ্মনাম কাউকে জানানো ঠিক হবে না। পিথিউশার কথা বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো ঈশান, বললো,
-‘কথা শেষ কর ভাইয়া। এতো ব্যস্ততার মাঝে প্রতিদিন দেখা করার সময় পায় সে?’
পিথিউশা প্রত্যুত্তর করে না। আকাশের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে, তার ঠোঁটের কোনে তির্যক হাসির রেখা। ঈশান কিছুটা অবাক হলো পিথিউশার বলা প্রতিটি কথায়, গত এক সপ্তাহে প্রতিদিন সে অতসীর সঙ্গে দেখা করেছে, মেয়েটা যথেষ্ট দেরী করে বাড়ি ফিরে। তাহলে পিথিউশার সঙ্গে দেখা হলো কখন! জিজ্ঞেস করতে গিয়েও কিছু বললো না ঈশান, যদি পিথিউশা ভাবে ঈশান অতসীকে পছন্দ করে তবে তো সে পিছিয়ে যাবে… নিরব থাকার সিদ্ধান্ত নেয় ঈশান। যা জানার সে নিজেই জানবে, পিথিউশাকে কিছু জানতে দেবে না। পিথিউশা তার মনের মতো একজনকে পাক তা চায় ঈশান, তার জন্য তাকে যা করতে হয় করবে সে… পিথিউশার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের ঘরে ফিরার জন্য পা বাড়ায় ঈশান। ছাদের দরজায় মা আরজু হককে দেখে একটু দাঁড়ায় ঈশান তারপর নিচে নেমে যায়। আরজু হক এগিয়ে গিয়ে পিথিউশার পাশে ছাদের মেঝেতে বসেন, পিথিউশা নিজের গায়ের চাদরটা খুলে মায়ের গায়ে জড়িয়ে দেয়। মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করে,
-‘কিছু বলবে মা? তুমি এলে কেনো? আমাকে কল করে নিচে ডাকতে…’
-‘কেনো রে? আমি তোর পাশে বসে আকাশ দেখলে তোর ভালো লাগে না?’
পিথিউশা মুচকি হাসে, মায়ের কোলে মাথা রেখে মায়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে,
-‘ওই উজ্জ্বল চাঁদটার থেকেও তোমার মুখটা সুন্দর মা, এই অন্ধকার রাতের আকাশভর্তি তারার থেকেও তোমার সঙ্গ আনন্দের মা। তোমার সন্তান হতে পেরে পিথিউশা নিজেকে ধন্য মনে করে।’
আরজু হক পিথিউশার এলোমেলো চুলগুলোতে হাত দিয়ে আরো এলোমেলো করে দেন, মুচকি হেসে বলেন,
-‘অনেক সুনাম করেছিস, এবার বল তো, সত্যিই মেয়ে ঠিক করেছিস নিজের জন্য? মেয়ে ঠিক কর, আমার তাতে আপত্তি নেই। তবে একটা কথা না বলে থাকতে পারছি না। বলবো না, বলবো না করেও বলতো হচ্ছে। আসলে না বলে স্বস্তি পাচ্ছি না।’
পিথিউশা শোয়া থেকে উঠে মায়ের দু’হাত নিজের হাতে নিয়ে বলে,
-‘মা, তুমি একবার যদি মানা করো আমি সব ছেড়ে দিতে পারি, নিজের প্রানটাও দিতে পারি। নিজের পছন্দের মেয়েতো সেখানে সামান্য জিনিস।’
আরজু হক পিথিউশার গালে হাত রাখেন, তার এই ছেলেটা বড্ড বেশি মা পাগল। মুচকি হেসে বলে,
-‘না বাবা, তোকে তোর পছন্দের মেয়েকে ছাড়তে বলবো না। আসলে তুই তো জানিস, এই পরিবার, তোরা, তোদের নিয়েই আমার ছোট্ট পৃথিবী। সেখানে একজন নতুন সদস্য আসবে তা সত্যিই আনন্দের। বিয়ের আগে তো নিশ্চয়ই তুই তাকে সব জানাবি, তোর অতীত, বর্তমান সব। তখন সে যদি সব জেনে বিয়ের পর তোকে নিয়ে আলাদা হয়ে যেতে চায়? আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারবো না বাবা। তুই আমাকে প্রথম মা বলে ডেকেছিস, আমাকে মাতৃত্বের স্বাদ দিয়েছিস, তোর বাবা, দাদু তারা তোকে কতো ভালোবাসে, ভরসা করে। আর ঈশান, ও তো এখনো অপরিপক্ক, তুই ওকে শক্ত হাতে ধরে রেখেছিস বলেই তো আজও ছেলেটা ঠিক পথে আছে। তুই না থাকলে আমাদের কি হবে?’
পিথিউশা নিজেকে বাইরে থেকে স্বাভাবিক রাখলেও তার ভেতরে আনন্দ ঝর্না বইছে। এ পরিবারে তার স্থান এতোটা মজবুত ভাবে নি সে। মাকে আশ্বস্ত করে সে বলে,
-‘আমার পরিবার আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, আমি এমন কাউকে কখনোই বিয়ে করবো না যে আমাকে আমার আপন মানুষগুলোর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেবে। আমি এমন কাউকে বিয়ে করবো যে আমার পাশাপাশি আমার আপন মানুষগুলোকেও আপন করে নেবে।’
স্বস্তির হাসি হাসেন আরজু হক, ছেলেকে তাড়া দিয়ে বলেন,
-‘ছাদে আর কতোক্ষণ থাকবি, বাসায় চল। খেয়ে দ্রুত শুয়ে পড়বি, রাত জাগিস কেনো তোরা কে জানে…’
মায়ের কথায় হাসে পিথিউশা, দাঁড়িয়ে মা’কে ধরে দাঁড় করায়। বাসায় যেতে যেতে বলে,
-‘তোমায় নিয়ে চিন্তা হয় মা, আমার বউ আসলে বউ-শ্বাশুড়ি মিলে না আমাকে নিয়ে ঝগড়া করো…’
আরজু হক পিথিউশার কান টেনে বলে,
-‘আমার ছেলের বউকে আমি নিজের মেয়ে করে রাখবো, ঝগড়া করলে তোর সঙ্গে করবো, তোর বউয়ের সঙ্গে না।’
মা, ছেলের মায়াভরা কথা কাটাকাটি চলে দীর্ঘক্ষণ, মা-ছেলের কথার শব্দে বসার ঘরে বেরিয়ে আসেন মহসীনুল হক। পিথিউশার হাসিমুখটা দেখে স্বস্তি পান মহসীনুল হক, পিথিউশার আনন্দ যে তার জীবনের অনেক বড় পাওনা… বিড়বিড় করে তিনি প্রার্থনা করেন পিথিউশার জন্য, তার নিঝঞ্ঝাট ভবিষ্যতের জন্য…
১৩
পিথিউশার ব্যপারে কারো সঙ্গে কথা বলতে না পেরে বেশ অস্থিরবোধ করছিলো অরিত্রী, অনেক ভেবে অমিতের সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলো। রাতে খাবার পর অমিতের ঘরে গিয়ে উঁকি দিলো অরিত্রী, মৃদু স্বরে বললো,
-‘তোর সঙ্গে একটা ব্যাপার আলাপ করার ছিলো রে অমিত। আসবো? ব্যস্ত হলে পরে আসবো।’
অমিত টেবিলে বসে পড়ছিলো, বই বন্ধ করে বললো,
-‘তুই আয় তো ছোটপু। কি বলবি বলে ফেল। আমার সঙ্গে এতো সংকোচের কি আছে?’
অরিত্রী আরাম করে বিছানায় বসলো, কোনো প্রকার ভণীতা না করেই বললো,
-‘একটা লোক আমাকে আপু ভেবে কথা বলছে, নিজের পরিচয় দেবো কি দেবো না বুঝতে পারছি না। তবে মনে হচ্ছে সে আপুকে পছন্দ করে এবং আমাকে আপু ভেবেই কথা আগাতে চাইছে। আমার কি করা উচিত বুঝতে পারছি না, তাছাড়া আপু সেজে কথা বলতেও মন চাইছে না। জানিস তো, মিথ্যা বলতে আমার ভালো লাগে না। অপরাধবোধে ভুগছি আমি বেশ কিছুদিন ধরে… কার সঙ্গে পরামর্শ করবো তাও বুঝতে পারছিলাম না, তাই অনেক ভেবে তোর কাছেই আসা…’
অমিত কিছুটা বিব্রতবোধ করলো, তার ছোটপু কখনো দোটানায় ভোগে না। সবসময় হাসিখুশি থাকে, সৎ পথে চলার চেষ্টা করে। সেই আপু আজ কাউকে নিজ পরিচয় দিতে সংকোচবোধ করছে! ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগলো অমিতের। কিছুক্ষণ ভাবার পর জিজ্ঞেস করলো,
-‘আপু, লোকটার নাম কি?’
-‘পিথিউশা’
চলবে…