তর্কে জড়ানো খুব একটা পছন্দ করেন না কবির সাহেব। বয়স হবে ৫০ এর কাছাকাছি। বলতে পারেন জীবনের মাঝামাঝি পর্যায়ে আছে। জীবনে অনেক স্বপ্ন ছিলো তার। পূরণ হলো কিছুটা তবে পুরোটা নয়। কত শত স্বপ্ন দেখেছিলো। সেসব ভাবছে বারান্দায় একটা কাঠের চেয়ারে বসে। চেয়ারের অবস্থাও কবির সাহেবের মতোই জীবনের মাঝামাঝি পর্যায়ে আছে বলা যায়। কবির সাহেবের যা আয় তাতে একটা নতুন চেয়ার অনায়াসে কিনতে পারবে। কিন্তু পুরোনোর প্রতি মায়াটা ত্যাগ করতে পারেন না। তাই যতদিন না ভেঙে যাবে এভাবেই চলতে থাকবে। হাতে চায়ের কাপ নিয়েই এসব চিন্তা করছিলেন। চিন্তায় এতো মনোযোগ দিলেন যে চা ঠান্ডা হয়ে গেছে সে দিকে খেয়ালই আসেনি। ঠান্ডা চা টাই চুমুক দিয়ে দিয়ে খেলেন। যেনো মনে হলো গরমই আছে। কবির সাহেব এর এ স্বভাব হয়তো কোনোদিন ও যাবেনা। জীবনের একটা পর্যায়ে তিনি খাতা কলমে এতোটাই আসক্ত ছিলেন যে মনে হতো লেখালেখি যেনো তার নিত্যদিনের পেশা। এতো কাজের চাপে লেখালেখিটাই কখন যে বন্ধ হয়েগেলো ভেবেই কুল পায়না। কাজের চাপ, সংসারের দায়িত্ব এসবে ব্যাস্ততা আনন্দ কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু এভাবে বাকি জীবন পার করতে চাননা। স্ত্রী, সন্তানদের প্রতিও ভীষণ বেখায়েলে হয়েছে সেটাও বেশ ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারছে। আরেকটা জিনিস কবির সাহেব লক্ষ্য করেছেন সালাত আদায় করতে পারছেন না ঠিকমতো। এ নিয়ে গত কয়েকদিন আগে কবির সাহেবের স্ত্রীর সাথে হাল্কা মনোমালিন্যও হয়েছিলো। কিন্তু এভাবে চলবে কতদিন! নিজেকে পরিবর্তন করতে হবে।
হঠাৎ বারান্দার দরজায় কচকা আওয়াজ হলো, পুরোনো বাড়ির পুরোনো দরজা। কবির সাহেবের স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে।
কি করছেন আপনি এখানে? আপনি আজকে অফিসে যাননি কেনো? আপনার ফোনে কতবার কল এসেছে!
কবির সাহেবের স্ত্রীর পুরোনো অভ্যাস এক নাগারে প্রশ্ন করে যাওয়া। আপনি করে বলাটাও তার কাছে প্রিয়। কতশত বছর ধরে চেনা পরিচিত কিন্তু আপনিতেই তার সন্তুষ্টি।
কবির সাহেবের স্ত্রীকে দেখে হঠাৎ তার মনে হলো, কতশত স্বপ্ন তাকে দেখিয়েছিলো কিন্তু কথা দিয়ে রাখতে পারেনি। এ নিয়ে কি তার আফসোস হয়না? এ বিষয়ে খুব জানতে ইচ্ছে করে কবির সাহেবের কিন্তু বলতে পারেনা।
কবির সাহেব এর উত্তর দেওয়া উচিৎ। কিন্তু তিনি ভাবনা চিন্তা ছেড়ে উত্তর দিলো।
-আজকে অফিসে যাবোনা।
-কেনো যাবেন না? কিছু হয়েছে আপনার?
-তেমন কিছুই হয়নি।
এতো ব্যাস্ততার মাঝে স্ত্রীকে যে তিনি গল্পের সুযোগ টা দিবেন তাও দিতে পারেনি। রীতিমতো এই মাঝবয়সী লোকটার কান্না করতে ইচ্ছে করছে।
কবির সাহেবের স্ত্রী তাকে অনেক সম্মান করে। যদিও তারা বয়সে এক।
স্ত্রী চোখে একরাশ উদ্বেগ। আচরণের ভিন্নতা দেখে অবাক হলেন।
-আপনি কি আসোলেও ঠিকঠাক আছেন? আমাকে বলতে পারেন।
-দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন, মনে তো হচ্ছে ঠিকঠাক নেই।
-কি নিয়ে এতো চিন্তিত? আপনার কর্মক্ষেত্রে ঝামেলা?
-না, সেসব কিছুইনা।
-বুঝলে রেহানা, এতো চাপ, ব্যাস্ততা আর ভালোলাগছেনা, নিতে পারছিনা আর! কি করি বলতো?! এই ব্যাস্ততা, ব্যাস্ততা করে, তোমাদের সময় দিতে পারিনি, নিজের সময়ও হাড়িয়ে ফেলেছি। লেখালেখিটাও, নামাজটা, নিজের সত্তাটাও…সব হাড়িয়ে ফেলেছি।
-এখনো সব হারায়নি। আপনি যদি চান আবার শুরু করতে পারেন।
কবির সাহেব আবারো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, -এখনো সময় আছে?
-সময় তো কখনো থেমে যায় না। শুধু আমরা থেমে যাই।
বহুদিন পর এভাবে খোলামেলা ভাবে তারা দুইজন গল্পে মেতে উঠেছে। কবির সাহেব তার স্ত্রীর সাথে কথা বলে এক অন্যরকম অনুভূতি পেলো। মনে হলো, এই মানুষটার সাথেই তো সে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো কাটিয়েছে, অথচ… কত অনুচ্চারিত কথা জমে আছে।
কবির সাহেব অনেকদিন পর একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। পুরোনো চেয়ার থেকে উঠে দাড়ালেন, শব্দ টা বলে দিচ্ছে কত বছরের পুরোনো! ধীরে ধীরে ঘরে যেয়ে, ড্রয়ার টা খুলে পুরোনো ডায়েরিটা বের করলেন। ধুলো জমে করুন অবস্থা। ধুলোগুলো সড়িয়ে একটা একটা করে পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগলো। সেই নতুন গন্ধ এখনো আছে!
একটা সময় কবির সাহেব- নতুন বই, খাতা, ড্রায়েরির ঘ্রাণ নিতো পাগোলের মতো!
কবির সাহেবের স্ত্রী বলছে, আপনার সব পুরোনো জিনিস এখনো আছে। শুধু আপনি নতুন হয়ে গিয়েছিলেন। আজ আপনাকে দেখে আনন্দিত লাগছে। পুরোনো আপনি টা ফিরে এসেছ!
কবির সাহেবের মুখে সেই পুরোনো হাসি। মন খুলে হাসছেন তিনি।
আমার স্ত্রী ধৈর্যশীলা মানুষ।
এই এত বছরেও সে কখনো জোর করেনি, চিৎকার করেনি, শুধুই পাশে থেকেছে।
হয়তো ভেতরে কষ্ট পেতো, হয়তো মাঝেমধ্যে রাত জেগে কাঁদতো,
তবু মুখে কিছু বলতো না।
আজ সেই মানুষটাই আমাকে নতুন করে চিনিয়ে দিলো—আমার পুরোনো সত্তাটাকে।
হয়তো আজ আবার লেখা শুরু করবো।
হয়তো আবার চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় বসে কবিতা ভাববো।
নতুন করে বাঁচতে শিখবো।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।
ঘরের বাতাসে আজ যেনো এক ধরনের নরম কোমলতা।
পেছন থেকে স্ত্রীর কণ্ঠ ভেসে এলো,
আজ সন্ধ্যায় একটু হাঁটতে বের হবেন? বহুদিন যাওয়া হয়নি।
আমি তাকিয়ে হাসলাম। ভাবলাম, বহুদিন পর আমার স্ত্রী আবদার করলো!
সত্যিই তো—হাজার ব্যস্ততার মাঝে জীবনটা ঠিক এমনই তো হয়ে যায়,
চাইলেই কি আবার শুরু করা যায় না?
হয়তো কবির সাহেবের গল্প এখানেই শেষ নয়।
বরং এখান থেকেই নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হয়।
জীবন টা বড়ই অদ্ভুত! আমরা সব সময় সেসব এর পেছনেই ছুটি যেসব আমাদের নিজেদের ব্যাক্তিগত সত্তাটাকেও আড়াল করে রাখে। নিজের আনন্দ, পছন্দ, ভালোলাগা সব হাড়িয়ে ফেলি শুধুমাত্র ব্যাস্ত জীবন পার করতে যেয়ে। ব্যাস্ত থাকা অবশ্যই উচিৎ। তাই বলে নিজে নিজেকেই হাড়িয়ে! ভাবলে অনেক কঠিন, সহজ করার ও উপায় অবশ্যই আছে। কিন্তু আমরা সেটা মানতে রাজি না! যতদিন না নিজেই সেটা অনুভব করছি ততদিন এইভাবেই কষ্টে দিন পার করে দিচ্ছি। কবির সাহেব ও জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় এ এসে উপলব্ধি করতে পারলো সে কতোগুলো সময় নষ্ট করে এসেছে! আপনি যেভাবে অফিসের বস কে অথবা কর্মচারীকে খুশি করাচ্ছেন দিনের পর দিন কাজ করে, সেখানে আপনার উচিৎ না? পরিবারকে সময় দিয়ে খুশি করে রাখার!