Close

ক্রায়োনিক্স (Cryonics) পদ্ধতিতে কি মৃত মানুষকে সত্যিই জীবিত করা সম্ভব?

ক্রায়োনিক্স (Cryonics)

ক্রায়োনিক্স (Cryonics)

কখনো কি ভেবেছেন মৃত মানুষ পুনরায় জীবিত হবে? মানুষের চিরন্তন এক স্বপ্ন হচ্ছে মৃত্যুকে পরাজিত করা। যুগে যুগে বিজ্ঞান, ধর্ম, দর্শন—সব ক্ষেত্রেই এই চিরন্তন স্বপ্নের ছোঁয়া পাওয়া যায়। আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে এই স্বপ্ন আজ কল্পনার গণ্ডি পেরিয়ে বাস্তবতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। এই ধারণারই একটি বাস্তবচিত্র হলো ক্রায়োনিক্স (Cryonics)। এটি এমন এক প্রযুক্তি বা প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে মানুষকে মৃত্যুর পর হিমায়িত করে ভবিষ্যতে পুনরুজ্জীবনের সম্ভাবনা তৈরি করা হয়। ক্রায়োনিক্স মূলত বিজ্ঞান এবং বিশ্বাসের মিশ্রণ।

কথিত আছে যে ধর্ম বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে এবং বিজ্ঞান বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে। কিন্তু বিজ্ঞানের বিশ্বাসের উপরও নির্ভরতা আছে! আমরা যেভাবে ফ্রিজে খাবার সংরক্ষণ করি, একইভাবে, একটি বিশেষ পদ্ধতিতে, রাসায়নিক প্রয়োগের মাধ্যমে মৃতদেহকে খুব ঠান্ডা অবস্থায় রাখা হয় যাতে মানবদেহের কোষগুলি ধ্বংস না হয়। শরীরের কোনও অংশই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, ঠিক যেমন একজন সাধারণ মানুষ ঘুমায়।

তবে, বরফ ব্যবহার করলে সাধারণত ঠান্ডা হয় না। কারণ শরীরের কোষগুলো এভাবে জমে যেতে পারে এবং ফেটে যেতে পারে এবং তাই ক্রায়োনিক্স বিশেষজ্ঞরা এতে কিছু বিশেষ রাসায়নিক প্রয়োগ করেন, যার সাহায্যে মৃতদেহের অঙ্গ থেকে শুরু করে রক্তনালীর ভিতরের অঙ্গগুলিকে ক্রায়োজেনিক টেম্পারেচার বা −196°C (লিকুইড নাইট্রোজেনের তাপমাত্রা) সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা সম্ভব। এমনকি বিজ্ঞানীরাও দাবি করেন যে মস্তিষ্কের প্রতিটি স্মৃতি অক্ষত থাকে! ভবিষ্যতে পুনরুত্থানের আশায় এভাবেই মৃতদেহ সংরক্ষণ করা হয়। এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে ক্রায়োনিক্স বা ক্রায়োপ্রিজারভেশন বলা হয়।

ক্রায়োনিক্স হল হাইবারনেশনের মতো। বর্তমানে জীবিত ব্যক্তির শরীরে ক্রায়োনিক্স নিষিদ্ধ, তাই একজন ব্যক্তিকে ক্লিনিক্যাল মৃত্যুর পর ক্রায়োপ্রিজারভেশনে রাখা হয়।

ক্লিনিক্যাল ডেথ মানে হলো হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়া। কিন্তু হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও মস্তিষ্কের কোষগুলো কিছুক্ষণের জন্য জীবিত এবং সক্রিয় থাকে। এমন অনেক ঘটনা আছে যেখানে হৃদস্পন্দন কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হয়ে যায় এবং তারপর ব্যক্তি আবার জীবিত হয়ে ওঠে। তাই, ক্রায়োবায়োলজিস্টরা বিশ্বাস করেন যে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত না হলে একজন ব্যক্তিকে মৃত বলে গণ্য করা যাবে না। তাদের মতে, ভবিষ্যতে এমন প্রযুক্তি আবিষ্কার করা হবে যার সাহায্যে মস্তিষ্কের তথ্য উদ্ধার করা যাবে।

ক্রায়োনিক্সের ইতিহাস

ক্রায়োনিক্স শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন রবার্ট এটিঞ্জার, যিনি ১৯৬২ সালে “The Prospect of Immortality” বইতে এই ধারণা তুলে ধরেন। ১৯৬৭ সালে প্রথমবারের মতো একজন মানুষ—ড. জেমস বেডফোর্ড—ক্রায়োনিক্যালি সংরক্ষিত হন। তিনি এখনো সংরক্ষিত অবস্থায় আছেন।

এরপর থেকে কিছু সংখ্যক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষ ও পোষা প্রাণী সংরক্ষণ করছে, যেমন:

  • Alcor Life Extension Foundation (যুক্তরাষ্ট্র)
  • Cryonics Institute (মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্র)
  • KrioRus (রাশিয়া)

কীভাবে কাজ করে ক্রায়োনিক্স?

ক্রায়োনিক্স একটি জটিল এবং সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া, যার প্রধান ধাপগুলো হলো:

  1. ক্লিনিক্যাল ডেথ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে শরীর ঠাণ্ডা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
  2. ব্লাড সার্কুলেশন ও অক্সিজেনেশন রক্ষা করার জন্য হৃদয়-ফুসফুস মেশিন ব্যবহার করা হয়।
  3. শরীর থেকে রক্ত বের করে তার বদলে ক্রায়োপ্রোটেকটেন্ট নামে একটি রাসায়নিক পদার্থ ঢোকানো হয়, যা বরফ তৈরি হওয়া রোধ করে।
  4. ধীরে ধীরে শরীরকে লিকুইড নাইট্রোজেনের মাধ্যমে −196°C এ হিমায়িত করা হয়।
  5. সংরক্ষিত দেহ বিশেষভাবে ডিজাইন করা ক্রায়োস্ট্যাটে রাখা হয়।

বিজ্ঞানভিত্তি ও সম্ভাবনা

ক্রায়োনিক্স এখনো একটি অপরিপক্ক ও পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান হিসেবে বিবেচিত। আজ পর্যন্ত কোনো হিমায়িত মানুষকে পুনরুজ্জীবিত করা যায়নি। তবে কিছু প্রাণী যেমন ব্যাঙ, কৃমি বা কোষকে হিমায়িত করে সফলভাবে জীবিত করা হয়েছে।

বিজ্ঞানীরা আশাবাদী যে:

  • ভবিষ্যতে ন্যানোটেকনোলজি ও রিজেনারেটিভ মেডিসিন এতটাই উন্নত হবে যে তারা কোষের ক্ষতিগুলো মেরামত করতে পারবে।
  • ক্লোনিং ও মস্তিষ্ক স্ক্যানিং প্রযুক্তির উন্নতির মাধ্যমে মেমোরি ও পরিচয় পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে।

নৈতিক ও আইনগত বিতর্ক

ক্রায়োনিক্স নিয়ে বেশ কিছু বিতর্ক রয়েছে:

১. নৈতিক প্রশ্ন

  • মৃত্যুকে “পরাস্ত” করা কি নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য?
  • সমাজে অসমতা তৈরি হবে না কি? কেবল ধনী ব্যক্তিরাই কি এই সুবিধা নিতে পারবে?

২. আইনগত জটিলতা

  • অনেক দেশে মৃত্যুর সংজ্ঞা নিয়ে দ্বিধা রয়েছে। ক্রায়োনিক্সের ক্ষেত্রে, একজনকে “আইনগতভাবে মৃত” ঘোষণা করলেও তার কোষগুলো তখনো জীবিত থাকতে পারে।
  • ভবিষ্যতে পুনরুজ্জীবিত ব্যক্তির আইনি পরিচয় কী হবে?

৩. ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ

অনেক ধর্মেই মৃত্যুকে একটি চূড়ান্ত অবস্থা হিসেবে দেখা হয়। ফলে মৃত্যুর পর মানুষকে পুনর্জীবিত করার চেষ্টা ধর্মীয় মূল্যবোধের বিরোধিতা করতে পারে।

খরচ ও প্রাপ্যতা

ক্রায়োনিক্স একটি ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। পুরো শরীর সংরক্ষণের খরচ প্রায় $২,৮০০০ থেকে $২,০০,০০০ পর্যন্ত হতে পারে। অনেকেই এটি লাইফ ইনস্যুরেন্স পলিসি ব্যবহার করে করেন। মাথা সংরক্ষণের খরচ তুলনামূলক কম।

এই প্রযুক্তি এখনো কেবলমাত্র যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ও ইউরোপের কিছু অংশে উপলব্ধ। বাংলাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশে এটি এখনো অনুপলব্ধ।

ভবিষ্যৎ ও কল্পনা

ক্রায়োনিক্সের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির উপর। কিছু সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ উন্নয়ন:

  • পূর্ণাঙ্গ শরীর বা মস্তিষ্কের পুনর্গঠন
  • স্মৃতির পুনঃস্থাপন
  • দেহ-মস্তিষ্ক পৃথকীকরণ ও কৃত্রিম দেহে স্থানান্তর

সাই-ফাই সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে যেমন Futurama, Vanilla Sky, Passengers, বা Altered Carbon-এ ক্রায়োনিক্স নিয়ে কল্পনাগুলো দেখা যায়, সেগুলো ক্রমেই বাস্তবতার দিকে এগোচ্ছে।

ক্রায়োনিক্স প্রসেস অ্যানিমেশন

অবশ্যই, আমি এটা বিশ্বাস করি না, আলোচনার খাতিরে তো কথাই নেই, একদিন মানুষ এই প্রযুক্তি পাবে। কিন্তু তবুও, এই ধারণা যে ক্রায়োপ্রিজার্ড মৃতদেহ সেই দিন পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকবে, এটি খুবই অবাস্তব ধারণা। ইতিহাস দেখিয়েছে যে একটি প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির একশ বছর ধরে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা হাজারে একটি।

এই পরিস্থিতিতে, একদিন মানুষ এত উন্নত প্রযুক্তিতে সজ্জিত হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক থাকবে এই আশা একেবারেই অযৌক্তিক। ক্রায়োনিক্স কোম্পানির ব্যর্থতা অতীতেও দেখা গেছে। জেমস বেডফোর্ড বাদে, ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত সমস্ত ক্রায়োপ্রিজার্ড মৃতদেহ বরফ গলিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে। যদিও ক্রায়োনিক্সের একটি বৈজ্ঞানিক অর্থ রয়েছে, মূলধারার বিজ্ঞান সম্প্রদায়ের মধ্যে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে এবং এটিকে সাধারণত ছদ্মবিজ্ঞান হিসেবে দেখা হয়।

আর্টিস্ট এবং লেখক

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Leave a comment
scroll to top