কালো রঙের ছেলে

মে 24, 2025 - 16:29
জুন 27, 2025 - 01:53
 0  0

গল্পের নাম:কালো রঙের আলো

লেখিকা: জেরিন জাহান দিশা 

ছেলেটার নাম রাফি।

গায়ের রঙ কালো- এই ছিল তার একমাত্র 'অপরাধ'। ছোটবেলা থেকেই পাড়ার ছেলেরা ডাকতো"কালা রাফি" বলে।এমনকি স্কুলের বন্ধুরাও উপহাস 

করতো। কেউ তার পাশে বসতে চাইতো না, কেউ খেলায় নিতো না।রাফি চুপচাপ সয়ে নিতো সব, হেসে যেন ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করতো। কিন্তু রাতে মায়ের কোলে মাথা রেখে 

চোখের জল ফেলতো।

"মা , আমি কি খারাপ কিছু করেছি?"

"না রে পাগল ছেলে,তুই তো আমার হীরার খনি,"মা আদর করে বলতেন।

রাফি পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলো। ক্লাস ফোর থেকে শুরু করে অনার্স পর্যন্ত প্রতিটা পরীক্ষায় টপ করেছিল। কিন্তু সমাজ তাকে কখনো শুধু মেধাবী রাফি বলে চিনতে শেখেনি-সে

থেকে গিয়েছিল "কালো ছেলেটা হয়েই। একদিন মাস্টার্স পরীক্ষার রেজাল্ট আনতে কলেজ যাচ্ছিল রাফি।বাসে উঠে জানালার ধারে বসলো। কিছুক্ষণ পর এক মহিলা এসে তার পাশে বসে, আবার উঠে গিয়ে অন্য সিটে চলে গেলেন। কন্টাক্টর এসে বলল,"ভাই,ডাবল ভাড়া 

দিতে হবে। আপনার পাশে তো কেউ বসে নাই।"

রাফি অবাক হয়ে বলল,"আমার পাশে কেউ বসে নি সেটা তো আমার দোষ না!আমি কেন ডাবল ভাড়া দেবো?"

 মহিলা হেসে বললেন,"আপনার পাশে কেউ বসে না,কারণ আপনি দেখতে ভয়ংকর।একটা স্কীন ডাক্তারের কাছে 

যান,উনি আপনার স্ক্রীন টা সুন্দর করার ব্যবস্থা করে দেবে।মহিলাটির 

কথা শুনে বাসের সব যাত্রী গুলো হেসে ফেললো।রাফি এতে অনেক কষ্ট পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। বুকের ভেতর যেন কিছু চুপচাপ পুড়ে 

যাচ্ছিল। সামনে বাসস্ট্যান্ডে রাফি নেমে পড়লো বাস থেকে। তারপর একটা রিক্সা নিলো কলেজ যাওয়ার 

জন্য। রিক্সায় বসে রাফি ভাবছে লোকজন কতো নিষ্ঠুর। মানুষ হয়ে 

মানুষকে অবহেলা করে ঘৃনা করে। মানুষ এইটা বোঝেনা মন ভাঙা আর 

মসজিদ ভাঙ্গা সমান কথাই। পাঁচ মিনিটের ভিতর রাফি কলেজ পৌছালো। রিক্সা ভাড়া দিয়ে রাফি 

কলেজের ভিতর ঢুকছে ।করিডোর 

দিয়ে হাঁটছে রাফি।এমন সময় রাবির

পুরানো বান্ধবী মিলির সাথে দেখা।

মিলি হেসে বলল,"রাফি,তোর রেজাল্ট 

কেমন হলো?"রাফি বলল, রেজাল্ট 

দেখতেই কলেজে আসলাম।তোর রেজাল্ট কেমন হয়েছে? মিলি হেসে বলল,"মোটামুটি। তবে তোর তো পাশ

করেও লাভ হবেনা।এই রঙ নিয়ে তো

চাকরি পাবিনা। তোকে চাকরির ইন্টারভিউ থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের 

করে দেবে।রাফির মিলির কথায় বুকটা চিরে গেলো।মুখ শক্ত করে বলল,"তোর সাথে আর কখনো দেখা হবে না মিলি।আজ শুধু আমাকে রেহাই দে।"কিছুক্ষণের মধ্যেই কলেজে খবর ছড়ালো-রাফি পুরো কলেজে প্রথম হয়েছে। মিলির বন্ধুরা 

এসে বলল,"শুনিছিস?রাফি টপ করেছে!"

মিলির রাগান্বিত হয়ে বলল,হ্যা রেজাল্ট সিটে দেখলাম এজন্যই তো

রাফিকে ইচ্ছে মতো অপমান করলাম। ওকে আমার সহ্য‌ই হয়না।

 রাফি কোন উত্তেজনা ছাড়াই স্যার -ম্যাডামদের সাথে দেখা করে, সম্মান 

জানিয়ে বাড়ি ফিরলো। সন্ধ্যার অন্ধকারে ঘরে এসে জানালার পাশে 

দাঁড়াল।বাইরে বাতাসে পাতার কাঁপছে,আর ভেতরে তার চোখের কোনায় পানি।

রাফির মা ঘরে ঢুকলো রাবির নাম ধরে ডাকছে রাফি সাড়া দিচ্ছে না।

রাফির মা বলল,"কিরে রেজাল্ট আনলি? ফোন করেছিলাম তোকে, ফোন বন্ধ পেলাম,"ঘরটা অন্ধকার করে রেখেছিস কেন?আলোটা জ্বালিয়ে দে?রাফি আরো জ্বালিয়ে 

দিলো।রাফির মা লক্ষ্য করছে রাফি

কাঁদছে।ছেলেকে বললেন,"কিরে কাঁদছিস কেনো।রাফির মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,মা কি এমন অপরাধ করেছি আমি। আমার গায়ের রং কালো বলে।সবাই আমাকে ঘৃণা করে।মা রাবির চোখের 

পানি শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দিলেন। বললেন,পাগল ছেলে কে বলেছে তুই কালো?তুই আমার হীরার

টুকরো ছেলে।রঙ দিয়ে মানুষকে মাপা যায়না। তোকে দেখলেই আমার পৃথিবী আলোয় ভরে ওঠে।মা বললেন

অন্যের কথায় কষ্ট পাবিনা কখনো।এখন বল তো? রেজাল্টের কি খবর তোর।রাফি বলল আমি কলেজে প্রথম হয়েছি।মা চমকে উঠলেন। আনন্দে ,গর্বে কেঁপে উঠলো কন্ঠ।

"আমার ছেলে তো আলোর দিশারি!আয় খা এবার,আমি তোর জন্য খাবার আনছি।মা খাবার নিয়ে এলো

রাফিকে নিজের হাতে খাইয়ে দিলো।

রাফি ও তার মাকে খাইয়ে দিলো।মা ছেলে একসাথে অনেক সুখ দুঃখের গল্প করলো।মা বলল, অনেক রাত হয়েছে বাবা এখন ঘুমিয়ে পড়।মা চলে গেলো।রাফি তার পুরানো ডাইরি 

বের করলো।হাতে একটা কলম নিয়ে 

লিখতে শুরু করলো।

"আমি বদলাবো না আমার র‌ঙ, আমি বদলাবো না দৃষ্টিভঙ্গি।

আমি দেখাবো,আলো কেবল সাদা নয়-কালোতে ও দীপ্তি আছে।"

পরের সপ্তাহে কলেজ থেকে একটি জাতীয় প্রতিযোগিতার জন্য রাফিকে মনোনীত করা হলো।এ‌ক‌ই সাথে,একটি স্বনামধন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরির ইন্টারভিউয়ের ডাক ও পেলো।

মিলি দূর থেকে তাকিয়ে দেখলো। এবার তার চোখে উপহাস নয়-ছিল বিস্ময়, অনুশোচনা আর খানিক শ্রদ্ধা। একদিন লাইব্রেরিতে রাফি একটা গল্পের ব‌ই পড়ছিল।মিলির

আসে লাইব্রেরিতে।মিলি দেখে রাফি 

চুপচাপ ব‌ই পড়ছে মনোযোগ দিয়ে।

মিলি রাফির পাশের চেয়ারে বসে বলল,"রাফি কেমন আছিস? আজকাল তো দেখাই যায় না।রাফি 

চমকে তাকালো। কোন কথার জবাব 

দিলোনা রাফি।মিলি বলল, আমি অন্যায় ভাবে তোকে অসম্মান করে

অনেক আজেবাজে কথা বলেছি।

আমাকে ক্ষমা করে দিস। এবার রাফি

ব‌ই পড়া বন্ধ করে মিলির চোখের দিকে শুধু তাকিয়ে র‌ইল।মিলি বলল,

তুই আমাকে একটা সুযোগ দে-তোর

পাশে থাকার।আমি তোকে শুধু ভালোবাসি না,সম্মানো করি।রাফি মিলির কথায় একটু হাসলো বলল,

বাহ! অসাধারণ কলেজের সুন্দরী মেয়ে আমাকে নাকি ভালোবাসে। আমাকে পছন্দ করে।কারন আমি ফাস্ট হয়েছি। ভালো একটা চাকরি পেয়েছি। যখন আমার পাশে কেউ বসতো না। তুই উপহাস করতি।আজ তুই পিছনে দাঁড়িয়ে হাত বাড়াচ্ছিস-তাও নিজের খুশির জন্য।মিলি মুখ নিচু করে রাখলো। বলার মতো কিছু নেই।

রাফি শান্ত কন্ঠে বলল,

"ভালোবাসা দয়া নয়।আর আমি দয়া করতে শিখিনি। আমার পাশে দাঁড়ানোর সাহস তুই হারিয়ে ফেলেছিস সেই অনেক আগেই। এখন শুধু দূর থেকেই দেখতে শেখ।মিলি

থেমে গেলো। চোখের কোনে অপ্রকাশ্য কিছু ভেসে উঠলো।রাফি

লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে চলে গেলো।মাথা উঁচু করে। বুকের ভেতর ছিল আত্মবিশ্বাস,আর পিছনে পড়ে ছিল একসময়ের ছোট করা অতীত।

রাফ জানে-কালো রঙ ছায়া হয় ঠিক‌ই, কিন্তু সেই ছায়া থেকেও আলো জ্বলে ওঠে।

What's Your Reaction?

Like Like 0
Dislike Dislike 0
Love Love 0
Funny Funny 0
Angry Angry 0
Sad Sad 0
Wow Wow 0
@zerin609 Zerin Jahan Disha Disha