মায়ের নদী ও বাবার পাহাড়, ভালোবাসার দুই নীরব ভাষা

পরিবারের কেন্দ্রে যদি কেউ নিঃশর্ত ভালোবাসার প্রতিমূর্তি হন, তিনি নিঃসন্দেহে মা। আর যদি কেউ আপাতদৃষ্টিতে সবচেয়ে 'বিরক্তিকর' বা কঠোর মনে হন, তিনি হলেন বাবা। মায়ের ভালোবাসা সহজ, দৃশ্যমান— নদীর বহমান ধারার মতো, যা সবসময় চোখে দেখা যায়। কিন্তু বাবার ভালোবাসা এক রহস্যময় পাহাড়ের মতো— নীরব, স্থির, যার গভীরতা এবং আশ্রয়দাতার ভূমিকা উপলব্ধি করতে জীবনের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। মায়ের ভালোবাসার ভাষা সরাসরি, উষ্ণ ও তাৎক্ষণিক : "খেয়েছ?"এই প্রশ্নে লুকিয়ে থাকে কেবল স্নেহ। অন্যদিকে, বাবার ভাষা হয় প্রচ্ছন্ন, দায়িত্বের ভারে চাপা, "টাকা বাঁচিয়ে খাও।"এই কঠোরতার গভীরে থাকে সন্তানকে আগামীকালের অনিশ্চয়তার প্রতি তাঁর সংবেদনশীলতা। বাবার প্রতিটি কথা আসলে তাঁর দায়িত্ববোধের প্রতিচ্ছবি। তিনি জানেন, আজকের সামান্য কৃপণতা আগামীর বড়ো কোনো বিপদ থেকে সন্তানকে রক্ষা করবে। মা যখন সন্তারের চোখে অশ্রু দেখেন, তখন তাঁর প্রথম কাজ হলো : বুকে টেনে সান্ত্বনা দেয়া, কারণ মায়ের হৃদয় স্নেহে গলে যায়। কিন্তু, বাবা যখন একই দৃশ্য দেখেন, তখন তাঁর প্রতিক্রিয়া হয় ভিন্ন : "এত দুর্বল কেন?" এই কঠোরতার নেপথ্যে থাকে এক গভীর অজানা ভয়— পৃথিবীর নিষ্ঠুরতা থেকে তাঁর সন্তানকে রক্ষা করার আকাঙ্ক্ষা। বাবা চান, সন্তানের ভেতরের 'আমি' যেন ইস্পাতের মতো শক্ত হয়, যেন বাইরের কোনো আঘাত সন্তানকে ভেঙে দিতে না পারে। মা বাঁচিয়ে রাখেন বর্তমানকে, আর বাবা নির্মাণ করেন সন্তানের ভবিষ্যৎ। মায়ের কাছে সন্তানের ভুল হলো : হাসির খোরাক, কারণ তিনি ভুলে যান। বাবার কাছে একই ভুল হয়ে ওঠে রাগের কারণ, কারণ তিনি দূরদর্শী। তিনি ভয় পান— এই ছোট ভুল যেন ভবিষ্যতে সন্তানের জীবন পথকে নষ্ট করে না দেয়। মা সন্তানের ক্ষত স্থানে হাত বুলিয়ে দেন, আর বাবা সেই ক্ষতকে সারানোর জন্য সন্তানকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখান। একজন সন্তানের হৃদয়কে নরম রাখেন, আর অন্যজন সন্তানের জীবনকে কঠিন বাস্তবের জন্য প্রস্তুত করেন। রাতের খাবার শেষে যখন মা বিশ্রামে যান, বাবা তখন নীরবে তাঁর জীবনের হিসাব মেলাতে বসেন। তাঁর মাথায় ঘুরতে থাকে— আগামী মাসের স্কুল ফি, সংসারের বাজার, বিদ্যুৎ বিল— কীভাবে এই নীরব বোঝা তিনি একাই বহন করে যাবেন। মায়ের ভালোবাসা প্রকাশ পায় মুখে, মিষ্টি কথায়, বাবার ভালোবাসা প্রকাশিত হয় নীরবে, চুপচাপ সন্তানের সমস্ত প্রয়োজন পূরণের মাধ্যমে। তাঁর কাঁধের বোঝা কমানোর জন্য তিনি কখনোই সন্তানকে অতিরিক্ত চাপ দেন না। সন্তানের ব্যর্থতায় মা সহজেই বলেন, "কিছু হবে না, আবার চেষ্টা করো।" এই সান্ত্বনা সন্তানকে দ্রুত হতাশামুক্ত করে। বাবা তখন প্রশ্ন করেন, "কেন ব্যর্থ হলে?" এই প্রশ্ন কোনো তিরস্কার নয়, বরং এর মধ্যে লুকিয়ে থাকে তীব্র আকাঙ্ক্ষা— সন্তান যেন জেতে, সন্তান যেন নিজের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে পারে। বাবার প্রশ্নটি একটি গভীর বিশ্লেষণত্মাক প্রক্রিয়া শুরু করার আহ্বান, যা তাঁকে ভবিষ্যতের সফলতার পথে চালিত করে। মা যখন ভালোবাসায় আচ্ছন্ন হয়ে সন্তানকে ঘরের ভেতরে সুরক্ষিত রাখেন, বাবা তখন কঠিন হাতে সন্তানকে ঠেলে দেন বাইরের জগতে—"যাও, লড়ো জীবনের সঙ্গে।" কারণ মা তাঁর সৃষ্টিকে রক্ষা করতে চান, আর বাবা সেই সৃষ্টিকে পৃথিবীর সঙ্গে মানিয়ে চলার মতো করে গড়ে তুলতে চান। আর একদিন, যখন বাবা থাকবেন না, তাঁর শূন্যতাই তখন তাঁর ভালোবাসার প্রকৃত ভাষা বুঝিয়ে দেয়। তখনই উপলব্ধি হয়— যিনি সবসময় সবচেয়ে 'বিরক্তিকর' মনে হতেন, তিনিই ছিলেন পরিবারের সবচেয়ে দৃঢ় স্তম্ভ, এক নীরব আশ্রয়দাতা। মায়ের ভালোবাসা নদীর মতো— সবসময় পাশে বইতে থাকে, অনুভব করা যায়। আর বাবার ভালোবাসা হলো পাহাড়ের মতো— সবসময় নীরব, স্থির, কিন্তু যে-কোনো ঝড়ে তিনিই একমাত্র আশ্রয়। সবাই ছোটোবেলায় মাকে বুঝে, কিন্তু জীবনে বড়ো হতে বোঝা যায়, যে মানুষটিকে সারাজীবন কঠিন বা বিরক্তিকর মনে করা হয়েছে, তিনিই ছিলেন ভালোবাসার সবচেয়ে কঠিন, কিন্তু সবচেয়ে খাঁটি ও অপরিহার্য রূপ।