ওজন নয়, আসল লক্ষ্য হওয়া উচিত মেটাবলিক স্বাস্থ্য
বছরের পর বছর আমরা অনেকেই ভেবে এসেছি — সুস্থ থাকতে হলে কম ওজনে থাকতে হবে।
ডায়েট প্ল্যান, ক্যালোরি কাউন্টিং, জিমে ঘাম ঝরানো — সবকিছুর লক্ষ্য একটাই, “ওজন কমানো।”
আসল সুস্থতা ওজনের সংখ্যায় নয়, অভ্যন্তরীণ ভারসাম্যই আসল লক্ষ্য যা লুকিয়ে আছে আমাদের বিপাকীয় স্বাস্থ্যে।
এমন প্রায়ই দেখা যায়, অনেকে দেখতে স্লিম হলেও ডায়াবেটিস বা হৃদরোগে আক্রান্ত। আবার কেউ একটু ভারী হলেও দারুণভাবে সুস্থ আছেন। কারণ, মূল বিষয় হলো শরীরের শক্তি ব্যবস্থাপনা — অর্থাৎ শরীর কীভাবে শর্করা, ইনসুলিন, কোলেস্টেরল ও প্রদাহ নিয়ন্ত্রণ করে।
বিপাকীয় স্বাস্থ্য আমাদের স্বার্বিক স্বাস্থ্যের মূল চাবীকাঠি। বিপাক বলতে শরীরের ভেতরে ক্রমাগত চলমান সমস্ত রাসায়নিক প্রক্রিয়াকে বোঝায় যা জীবন এবং সর্বময় শারীরিক স্বাভাবিক কার্যকারিতা বজায় রাখা সম্ভব করে তোলে। শরীরের স্বাভাবিক কার্যকারিতা বজায় রাখাকে হোমিওস্ট্যাসিস বলা হয়। এই প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে রয়েছে আমাদের খাদ্য থেকে পুষ্টি উপাদান সংগ্রহ এবং আমাদের শরীর গঠন এবং মেরামতে তার সঠিক ব্যাবহার করা।
মেটাবলিক বা বিপাকীয় স্বাস্থ্য ঠিক আছে মানে শরীরের বিভিন্ন সিস্টেম কতটা সঠিকভাবে কাজ করছে।
যখন এই ভারসাম্য নষ্ট হয়, তখনই বাড়ে দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি — যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, বা ফ্যাটি লিভার।
বিপাকীয় স্বাস্থ্য ৫টি ক্লিনিকাল মার্কার এর সর্বোত্তম মাত্রা দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয়:
· রক্তে শর্করার মাত্রা
· ট্রাইগ্লিসারাইড
· উচ্চ-ঘনত্বের লাইপোপ্রোটিন (HDL) কোলেস্টেরল
· রক্তচাপ
· কোমরের পরিধি।
এই মার্কারগুলোর স্বতন্ত্র মান এবং এর পরিবর্তনশীলতা উভয়ই আমাদের বিপাকীয় স্বাস্থ্যের ব্যাখ্যায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৮ জনের মধ্যে ৬–৭ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বিপাকীয় অসুস্থতায় ভূগছে — এমনকি যাদের ওজন “স্বাভাবিক” বলে মনে হয়, তারাও।
চিকিৎসা সাস্ত্র বলছে, এটি এক নীরব মহামারি, যা ধীরে ধীরে জীবনের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
তাই শুধু ওজন নয়, দেখতে হবে শরীরের হরমোন, রক্তের শর্করা আর কোষীয় কার্যক্ষমতা ঠিক আছে কিনা। একজন যতই ডায়েট করুক না কেনো, যদি মেটাবলিজম ঠিক না থাকে, সুস্থ্যতা অর্জন সম্ভব হয় না। পুরোনো ধারণা ছিল যত ক্যালোরি খাওয়া হচ্ছে ততটা বার্ন করলেই আমরা ঝুঁকি মুক্ত থাকতে পারবো। কিন্তু আধুনিক পুষ্টিবিজ্ঞান বলছে, কি খাওয়া হচ্ছে এবং কখন খাওয় হচ্ছে তাও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সুষম খাদ্যাভ্যাস আমাদের বিপাকীয় স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি মানব শরীরে প্রয়োজনীয় সকল ধরণের পুষ্টিউপাদানের সমন্বয়ে গঠিত হয়।
প্রোটিন, ফাইবার ও স্বাস্থ্যকর ফ্যাটের সমন্বয়ে গঠিত ব্যালেন্সড খাবার শরীরের হরমোন ভারসাম্য ও ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ায়। অন্যদিকে, প্রক্রিয়াজাত খাবার, চিনিযুক্ত পানীয় বা পরিশোধিত কার্বোহাইড্রেট শরীরে ইনসুলিন নিঃশরণ বাড়ায় এবং প্রদাহ সৃষ্টি করে।
জীবনযাত্রায় সহজ কিছু পরিবর্তনেই মেটাবলিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখা সম্ভব, যেমন—
· প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণ কমিয়ে দেওয়া
· প্রতিদিন অন্তত ৭–৮ ঘণ্টা ঘুমানো
· নিয়মিত ব্যায়াম করা, বিশেষ করে স্ট্রেন্থ ট্রেনিং
· মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা
সুস্বাস্থ্য মানে এখন শুধু ওজনের সংখ্যা নয়, লক্ষ্য শুধু “পাতলা হওয়া” নয়। শরীরের ভিতরের সিস্টেমকে মজবুত করাই এখন মূল লক্ষ্য যেন আমরা দীর্ঘদিন শক্তি, মনোযোগ আর জীবনীশক্তি ধরে রাখতে পারি। ওজন কমানো আসলে এই প্রক্রিয়ার ফল। যখন শরীরের সকল সিসটেমে ভারসাম্যে আসে, তখন স্বাভাবিকভাবেই ওজনেও ভারসাম্য আসে।
-ক্লিনিকাল ডায়েটিশিয়ান
সানজিদা শারমীন
What's Your Reaction?
Like
0
Dislike
0
Love
0
Funny
0
Angry
0
Sad
0
Wow
0